নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করাই মূল কাজ: আসিফ নজরুল

রাষ্ট্রের প্রধান তিন অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে আগে ঠিক না করলে মানবাধিকার কিংবা গণতন্ত্র নিয়ে অন্য যেকোনো পদক্ষেপ কার্যকর হবে না বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, 'এই তিনটি অঙ্গে যদি হাজার হাজার সমস্যা রেখে দেন, তাহলে তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করে, দাতা কমিশনের বাহবা পেয়ে কিংবা যত সভা-সিম্পোজিয়াম-সেমিনারই হোক; কোনো লাভ হবে না। আমাদের আসল জায়গাতে হাত দিতে হবে।'
শনিবার (২৬ জুলাই) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) আয়োজিত ১১তম মানবাধিকার সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আইনের প্রয়োগ না থাকায় পরিবেশ দূষণসহ নানা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, 'আমাদের দেশে ভালো ভালো আইনের অভাব নেই। অসাধারণ পরিবেশ আইন রয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। এখন শুধু ঢাকা নয়, আশপাশের এলাকাগুলোতেও দূষণ বাড়ছে। আইন দিয়ে সবকিছু হয় না, আমাদের সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান গড়া। কিন্তু এ কাজটা আমরা করছি না।'
তিনি বলেন, 'আমরা ভাবি, আইন পরিবর্তন করলেই দেশ ঠিক হয়ে যাবে। অনেকে বলে, সংবিধানে নতুন ধারা যোগ করলেই মানুষ পরিবর্তন হয়ে যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো সংবিধান মালদ্বীপের, কিন্তু সেখানে কী হয়েছে? আরব বসন্তের পর একমাত্র তিউনিসিয়ায় সংবিধান পরিবর্তন করে ভালো কিছু করা গিয়েছিল। কিন্তু এরপর সেখানে ১০ বছরে ১১ বার সরকারের পতন হয়েছে। প্রত্যেক শাসক আগের জনের চেয়ে খারাপ হয়েছে।'
মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়বদ্ধতার অভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আমরা যারা অন্যের সমালোচনা করি, নিজেরা কি উত্তরসূরি নির্ধারণ করি? বড় পত্রিকা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বা থিংক ট্যাঙ্কগুলো কি উত্তরসূরি রেখে যায়? আমার দেখায়, ফজলে হাসান আবেদ ছাড়া কেউ তা করেননি। যারা স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার কথা বলেন, তারাই সেটা মেনে চলেন না।'
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)–এর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'এত বড় সংগঠন, কিন্তু আমরা জানি সেখানে কী হয়েছে। প্রচণ্ড স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব ছিল। তদন্ত হয়েছে, কিন্তু ফল প্রকাশ হয়নি।'
মানবাধিকার রক্ষায় আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির ওপর জোর দিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, 'শুধু রাজনীতিবিদ বা দলকে দায় দিলে চলবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, এমনকি প্রতিটি অফিসে স্বচ্ছতা আনতে হবে। আগে আত্মসমালোচনা করতে হবে। এরপর আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনলে সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব।'
নির্বাচনকে অবমূল্যায়নের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'অনেকে বলেন, নির্বাচন ই কি সব? আমি কিছুতেই বুঝি না তারা কীভাবে এটা বলেন। স্মুথ ট্রানজিশন অব পাওয়ার না থাকলে অ্যাকাউন্টেবিলিটি আসে না। ১৯৯১ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো সময় গেছে কারণ তখন ক্ষমতা শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর হতো। যেই রাজনৈতিক দল জানে, পাঁচ বছর পর তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, সে ভয়েই হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে। আর যখন এ ভয়টা থাকে না, তখন কী দানবীয় আচরণ হয়—আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনকাল থেকে তা বোঝা যায়।'
সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত সামিউ আমান নূরের বড় বোন আরফিন আমান, শহীদ নাইমা সুলতানার মা আইনুন্নাহার বেগম, শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি।
এছাড়া বক্তব্য দেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এইচআরএসএস–এর প্রধান উপদেষ্টা মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান, জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ একরামুল হক।