নিম্ন মানের কয়লা পাওয়ার পর জিটুজি পদ্ধতিতে কয়লা সংগ্রহে করতে চায় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র

বেসরকারি সরবরাহকারীর কাছ থেকে নিম্ন মানের কয়লা পাওয়ার পর মহেশখালীর মাতারবাড়ী ১,২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরাসরি রাষ্ট্রমালিকানাধীন খনি থেকে কয়লা সংগ্রহ করতে ইন্দোনেশিয়া সরকারের সঙ্গে জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে) চুক্তি করতে চায় কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) কর্মকর্তা মনে করছেন, জিটুজি পদ্ধদিতে কয়লার মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যয় সংকোচনও হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকবে না; এবং উন্মুক্ত দরপত্র না হলে সরকার ন্যূনতম মূল্য ক্রয় অনিশ্চয়তার মুখেও পড়তে পারে।
সিপিজিসিবিএলের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্লোবাল ট্রেডিং (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেডের কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা চালানে নিম্ন মানের কয়লা পাওয়ার পর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এ বছরের মার্চে মাটি মিশ্রিত কয়লার চালান গ্রহণ করেনি সিপিজিসিবিএল।
গত ২৮ মে অনুষ্ঠিত সিপিজিসিবিএলের বোর্ড সভায় জিটুজি পদ্ধতিতে ক্রয় প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট) দীপায়ন পাল স্বাক্ষরিত জিটুজি ভিত্তিতে কয়লা ক্রয় প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয় উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া সরকারের মালিকানাধীন কয়লা খনির (যেমন: বুকিত আসাম) সঙ্গে সিপিজিসিবিএল চুক্তি সম্পাদন করতে।
চুক্তিতে আন্তর্জাতিক ইনডেক্স অনুযায়ী কয়লার মূল্য নির্ধারণ, বার্ষিক কয়লার চাহিদা, কয়লার গুণগত মান বর্ণিত থাকবে। কয়লা কেনা হবে এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) পদ্ধতিতে। কয়লার পরিবহন-সংক্রান্ত কার্যক্রম বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
আগামী অক্টোবরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা সরবরাহের বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মাটি মিশ্রিত কয়লার চালান প্রত্যাখ্যানের পর গত এপ্রিল থেকে বিদুৎকেন্দ্রটির ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে।
গত ৩০ এপ্রিল ও ১৭ মে অনুষ্ঠিত দুটি বোর্ড সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখতে দুটি লটে দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে আলোচনা হয়। এরপর দরপত্রের নথিপত্র প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।
সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট) দীপায়ন পাল টিবিএসকে বলেন, 'দরপত্রের নথিপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন। এ বিষয়ে এখন কিছু বলা যাবে না। আর বোর্ডের সিদ্ধান্তক্রমে জিটুজি চুক্তির বিষয়টি নিয়েও কাজ চলছে।'
সিপিজিসিবিএল আশা করছে, জিটুজি ভিত্তিতে কয়লা কিনলে মানসম্মত কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া সরাসরি কয়লা খনির সঙ্গে কয়লা ক্রয়ের চুক্তির ফলে কোনো ঠিকাদার নিয়োগের প্রয়োজন হবে না। এতে কয়লার আমদানি ব্যয় কমবে।
বিএসসির প্রক্ষেপণ অনুসারে, প্রতি মেট্রিক টন কয়লা পরিবহনে খরচ হবে ১০.৬৯ ডলার। বর্তমান চুক্তির আওতায় কয়লা পরিবহন ব্যয় গড়ে ১৮-২০ ডলার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বার্ষিক কয়লার চাহিদা ৩৫ লাখ টন।
জিটুজি চুক্তির বিপক্ষে বিশেষজ্ঞরা, উন্মুক্ত দরপত্রের আহ্বান
জিটুজি চুক্তির ভিত্তিতে কয়লা সংগ্রহের বিপক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে এর আগে এমন নজির নেই এবং এতে প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও তত্ত্বাবধায়ক সাবেক সরকারের উপদেষ্টা ম তামিম টিবিএসকে বলেন, 'অন্তর্বর্তীসরকার বিশেষ আইন বাতিল করে সবক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার প্রতি জোর দিচ্ছে। জিটুজি চুক্তি করলে তো আর কোনো প্রতিযোগিতা থাকে না। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে নূন্যতম মূল্য বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকছে না।'
তিনি আরও বলেন, সাধারণত অর্থায়নের প্রকল্প বা প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে জিটুজি চুক্তি করা হয়। এখানে কয়লা সরবরাহ তেমন বিষয় নয়।
'মাতারবাড়ীতে নিম্নমানের কয়লা সরবরাহ ব্যতিক্রম ঘটনা। সরবরাহকারী চুক্তি লঙ্ঘন করলে আইন অনুযাযী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমি মনে করি, সরকারের উচিত উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কয়লা সংগ্রহ করা,' বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, উন্মুক্ত দরপত্র, জিটুজি ও পিপিপি— এই তিনটি পন্থাই বৈধ।
'মাতারবাড়ীর কয়লা সরবরাহে একটি সিন্ডিকেট করে রাখা হয়েছে। তিনটি কোম্পানি অংশ নেয়, কিন্তু ঘুরে-ফিরে একটি কোম্পানিই কাজ পায়। এজন্য আমরা জিটুজি পদ্ধতি পর্যালোচনা করছি। যেখানে সস্তা পাব, সরবরাহ নিশ্চিত হবে, সেখান থেকেই নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।
নিম্ন মানের কয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র, কিন্তু এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে কনসোর্টিয়াম মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক বছরের জন্য কয়লা সরবরাহের কাজ পায়। তাদের সরবরাহ করা নিম্নমানের কয়লার কারণে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত ১৭ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহকারীর আমদানি করা কয়লার ১১তম চালানে বিপুল পরিমাণে মাটি, পাথর, লালচে কণা ও অতিরিক্ত পানি পাওয়ার পর চালানটি ফিরিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ।
সরবরাহকারী কয়লা ক্রয়ের দরপত্রের উল্লেখিত মানদণ্ড পূরণ করছে না—এমন অভিযোগে সিপিজিসিবিএল এর আগে প্রথম দশটি চালানের প্রতিটির ১০ শতাংশ পেমেন্ট আটকে রেখেছিল।
নিম্ন মানের কয়লা ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিটের সিল ও টিউব ক্ষয় হয়েছে। অনেক স্লাগ জমে প্ল্যান্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কারণে ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎকটিন্দ্রের ৬০০ মেগাওয়াটের ইউনিট বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিম্ন মানের কয়লা সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
উল্টো আগে বাতিল করা কয়লার চালানটি পাঁচ শর্তে খালাসের অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে—কয়লার ভেতর থাকা সব ধরনের বহিরাগত উপাদান সরবরাহকারীকে নিজ খরচে আলাদা করতে হবে; কয়লায় থাকা পানির পরিমাণ ওজন করে প্রকৃত ওজন থেকে বাদ দিতে হবে; বন্দরে অতিরিক্ত অবস্থানজনিত (ওভারস্টে) ফি সরবরাহকারীকে পরিশোধ করতে হবে; কনভেয়র বেল্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; কয়লা সরবরাহ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটালে জরিমানা দিতে হবে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, 'চুক্তি লঙ্ঘন, উৎপাদন বন্ধ থাকা ও প্ল্যান্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় নিম্ন মানের কয়লা সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে না। বিষয়টি সন্দেজনক।'
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, চুক্তি লঙ্ঘনকারীর কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন কাজ করার সাহস পাবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, বিষয়গুলো মূল্যায়ন পর্যায়ে আছে। এখনও কোনো উপসংহারে আসেনি।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, 'আমরা এখন প্ল্যান্ট পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি। চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'