ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে বরগুনার অধিকাংশ ওয়ার্ড: আক্রান্ত ২,৪০৭, মৃত্যু ৬ জনের

বরগুনা পৌরসভায় মারাত্মক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টি ওয়ার্ডকে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আজ (২৫ জুন) আইইডিসিআর অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর-এর পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, 'এই মুহূর্তে প্রাদুর্ভাবের প্রকৃত মাত্রা নির্ধারণ করা এখনও খুব তাড়াতাড়ি হবে। আরও সময় ও তথ্যের প্রয়োজন।'
এ বছর এখন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৭০ এবং মৃতের সংখ্যা ৩৬ জন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরগুনা জেলাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৪০৭ এবং মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের, যা জেলার পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বিপর্যস্ত এলাকার একটিতে পরিণত করেছে।
আইইডিসিআর-এর রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. তাহমিনা শিরিন জানান, বরগুনা সদর উপজেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি, এরপর রয়েছে পাথরঘাটা ও বামনা। বেতাগী ও আমতলী উপজেলায় সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম। তিনি আরও বলেন, 'বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্য না থাকায় অনেক সংক্রমণ এখনো শনাক্ত না-ও হতে পারে।'
আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যৌথ দল ১৬ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে তদন্ত চালিয়ে উদ্বেগজনক কীটতাত্ত্বিক (এন্টোমোলজিকাল) তথ্য তুলে ধরে।
ভাইরোলজিক্যাল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৪৬.৫ শতাংশ ডেংগু ভাইরাস-৩, ৩৯.৫ শতাংশ ডেংগু ভাইরাস-২ দ্বারা সংক্রমিত। এছাড়া, ১৪ শতাংশ রোগীর শরীরে ডেন-২ ও ডেন- ৩ উভয় প্রকারের ভাইরাস পাওয়া গেছে।
ডেংগু ভাইরাসের ডেন-২ ও ডেন-৩ সেরোটাইপকে অত্যন্ত রোগপ্রবণ জিনোটাইপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা সাধারণত বেশি জটিলতা ও গুরুতর রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বরগুনা সদর উপজেলায় ব্রেটু সূচকে এডিস মশার ঘনত্ব ১৫৩ শতাংশ পাওয়া গেছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ সীমার ২০ শতাংশের অনেক ঊর্ধ্বে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরে মশার লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় ৮.৫ গুণ বেশি।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাস পরিবেশগত কিছু বিষয়কে এই সংকটের জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'বরগুনায় নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। অনেকেই বড় পাত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন, কিন্তু সেগুলো ঢেকে রাখা বা পরিষ্কার রাখার বিষয়ে সচেতনতা নেই।' এই অব্যবস্থাপনা এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি মশারি ব্যবহার করেন না, যার ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়ির ভেতরের প্লাস্টিক ড্রাম, মগ, ফুলের টব ও বোতলের মতো পাত্রে মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে, এবং বাড়ির ভেতরের তুলনায় বাইরের চেয়ে লার্ভার ঘনত্ব বেশি।
বরগুনার হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে বিধায় সেখানে আটজন মেডিকেল অফিসার ও দুইজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, নতুন ভর্তি ৩২৬ জন
গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে, ফলে চলতি বছরে এডিস মশাবাহিত রোগে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ জনে।
একই সময়ে সারা দেশে ৩২৬ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) দৈনন্দিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ২৫৫ জন ঢাকার বাইরের। তাদের মধ্যে ১১৮ জন বরিশাল বিভাগের।
গত বছর (২০২৪) ডেঙ্গুতে সারা দেশে ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। একই বছরে মোট ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং ১ লাখ ৪০ জন সুস্থ হয়েছিলেন, বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।