ত্রিমুখী হুমকি: চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু ও কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা

দেশে ডেঙ্গুর পাশাপাশি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে শনাক্ত হচ্ছে চিকুণগুনিয়াও। হাসপাতালে রোগীরা দেরিতে আসায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড মহাখালী হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু ও কোভিড রোগীর চাপ বাড়ছে। রোগীর চাপ মোকাবেলায় আরো জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সাঈদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রিভেন্টিভ মেজারস অর্থাৎ মশক নিধনে ব্যর্থতার কারণে ডেঙ্গু বাড়ছে, তবে আমরা চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সমস্যা হলো ডেঙ্গু রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। জ্বর হলেই হাসপাতালে আসলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমবে।
তিনি আরও বলেন, 'এখন শুধু ডেঙ্গু না কোভিড, চিকুনগুনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তাই জ্বর হলেই হাসপাতালে যেতে হবে, চিকিৎসকেরা রোগ নির্ণয় করে ঠিক করবেন কি করতে হবে। কোভিড পরিস্থিতি অ্যালার্মিং না তবে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্য বিধি মানার বিকল্প নাই।'
ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড মহাখালী হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন আমরা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গি রোগী পাচ্ছি, পাশাপাশি কোভিড রোগীও আসছে। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী কিছুটা কম। বর্তমানে ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী আর ১৭ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছে। দুই দিন আগে একজন চিকুনগুনিয়া রোগী ভর্তি ছিল, আজ কোন চিকুনগুনিয়া রোগী ভর্তি নেই।'
তিনি রোগীর মধ্যে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে আইইডিসিআর বা আইসিডিডিআরবিতে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, 'আমাদের আউটডোরে এখন প্রতিদিন ৫৫০-৬০০ রোগী আসছে। রোগীর প্যাটার্ন দেখে মনে হচ্ছে এ সংখ্যা শিগগিরই ১০০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমাদের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত স্যালাইন, টেস্টিং কিট, অক্সিজেনসহ সব ধরনের প্রস্তুতি আছে।'
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এফ এম মোফাখখারুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'এখন আমরা হাসপাতালে ও চেম্বারে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী বেশি পাচ্ছি। এর পাশাপাশি অন্যান্য টাইফয়েড ও ইনফ্লুয়েঞ্জা আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া রোগ বেশি হচ্ছে। চিকুনগুনিয়ায় সরাসরি পিসিআর টেস্ট করতে হবে। আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর'বি ও যাদের পিসিআর ল্যাব আছে তাদের ওখানে টেস্ট হয়। আমার মনে হচ্ছে টেস্ট কম হওয়ায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত কম হচ্ছে।'
বাড়ছে তিনটি রোগই
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা) চিকুনগুনিয়া এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামে করোনায় দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। এর আগে ১৬ জুন চট্টগ্রামে ৭৫ বছর বয়সী একজন পুরুষ মারা গেছেন।
চলতি বছর দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩৯৩ জন ও মারা গেছেন ৮ জন। এর মধ্যে জুন মাসের ২১ দিনে মারা গেছেন ৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ জন মারা গেছে এবং ৩৫২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যা একদিনে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী।
২০১৭ সালে দেশে ব্যাপক হারে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়েছিলো। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে জিকায় ১১ জন ও চিকুনগুনিয়ায় ৬৭ জন আক্রান্তের খবর জানিয়েছে আইইডিসিআর।
সরকারি পর্যায়ে শুধু ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও আইইডিসিআরে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
চলতি বছরের গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ৩৩৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৩ জনের দেহে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করেছে আইইডিসিআর। আক্রান্ত সবাই ঢাকার বাসিন্দা।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, একটা পরীক্ষার মাধ্যমেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা শনাক্ত করা যায়। আলাদা পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। এবার চিকুনগুনিয়া নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত হচ্ছে ৪৫ শতাংশ। তবে কারও মৃত্যু হয়নি।
সব রোগের লক্ষণ একই
অধ্যাপক ড. এফএম মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, 'ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই ভাইরাল রোগ, দুটিই এডিস মশা জনিত রোগ। দুটো রোগেই অনেক জ্বর হয়। তবে ডেঙ্গুতে মাথায়, কোমড়ে চোখে ব্যথা হয়। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জয়েন্টে ব্যথা হয়। কিছু কিছু পেশেন্ট আছে যারা ব্যথায় দাঁড়াতেই পারেনা। জয়েন্ট পেইন, জয়েন্ট ফুলে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ট্রিটমেন্ট হলো সিমটোমেটিক অর্থাৎ লক্ষণ দেখে চিকিৎসা। ডেঙ্গু হলে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যায় না। চিকুনগুনিয়ায় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা যায়। তাই চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ডেঙ্গুতে শক সিনড্রোমে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। চিকুনগুনিয়া মৃত্যু ঝুঁকি নাই কিন্তু ভোগান্তি বেশি। কিছু রোগী ৬ মাস-১ বছর পর্যন্ত এ ব্যথায় ভোগে।'
কোভিডের কিট কেনা হচ্ছে
এ বছর কোভিড শনাক্ত শুরু হওয়ার পর কয়েক হাজার কিট গিফট পেয়েছে সরকার। সেসব দিয়ে এখন টেস্ট করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরের কিছু কিছু জেলায় করোনাভাইরাসের কিট সংকট দেখা দিয়েছে। এখন কোভিড টেস্ট কম হচ্ছে, টেস্ট বাড়লে কিট সংকট আরো বাড়বে।
কিট কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আগামী মাসের মধ্যে কিট সংকট কাটবে বলে জানিয়েছন ড. সাঈদুর রহমান।
তিনি আরো বলেন, 'আগামী মাসের মধ্যে কিট সংকট থাকবেনা। স্যাম্পল কালেকশন বুথ বাড়ানো হবে যাতে মানুষ নাগালের মধ্যে টেস্ট করতে পারে।'