‘এনসিপিকে নির্বাচনের রাজনীতিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে’, নিবন্ধন ও জুলাই সনদে মনোযোগী দলটি

প্রয়োজনীয় সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায় ও গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে 'জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজনীতি' করার লক্ষ্য থাকলেও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) 'নির্বাচনি রাজনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে' বলে দাবি করছেন দলটির নেতারা।
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের একাংশের নেতৃত্বে গঠিত দলটির কয়েকজন নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, যদিও এই মুহূর্তে তারা প্রধান্য দিচ্ছে দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া এবং জুলাই সনদের দাবি বাস্তবায়ন করায়।
দলটি ইতোমধ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেছে। একইসঙ্গে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় সেল, ও জেলা-উপজেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। আজ রোববার (২২ জুন) দলটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার কথা রয়েছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব টিবিএসকে বলেন, 'অভ্যুত্থানের রাজনীতি আমাদের মূল বিষয়। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার শেষে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরই নির্বাচনকেন্দ্রিক মূল আলোচনা সামনে আসবে। আপাতত আমাদের নিবন্ধনকেন্দ্রিক তৎপরতাই প্রাথমিক অগ্রাধিকার।'
আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে সম্প্রতি তীব্র টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। বিএনপি ডিসেম্বরে ভোটের জন্য চাপ দিলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তবে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের পর উত্তেজনা কিছুটা কমে আসে। বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এনসিপি এখনও দাবি করছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার পরেই নির্বাচন হওয়া উচিত।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমীন টিবিএসকে বলেন, 'ক্রমাগত আমাদেরকে আসনের আলাপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসনের আলাপে যেতে না চাইলে আমাদের নামে মিথ্যা গল্প ছড়ানো হচ্ছে এবং মোটাদাগে আমাদেরকে নির্বাচনের রাজনীতিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা তো আমাদের চয়েস না।'
এনসিপি এখনও গণপরিষদ নির্বাচন চাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা কিন্তু বারবারই বলছি গণপরিষদ নির্বাচন চাই। কিন্তু "নির্বাচন, নির্বাচন" এমনভাবে বলা হচ্ছে, যাতে গণপরিষদ নির্বাচন যে আমাদের দাবি এবং এটাই যে সংষ্কারের একমাত্র স্থায়ী প্রক্রিয়া এই আলাপে কেউ যেন ঢুকতে না পারে।
'এটি একটি সুদৃঢ় পরিকল্পনার অংশ। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বিএনপি আপারহ্যান্ডে থাকবে বলে মনে করছে। সেটা তাদের ধারণামাত্র, এটা সত্যতা নয়।'
দলটির রাজনৈতিক লিয়াজো কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, নির্বাচন যেকোনো মাসে হতে পারে—কিন্তু তার আগে জুলাই ঘোষণাপত্র, মৌলিক সংস্কার ও বিচার শেষ করতে হবে।
'তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং তার সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে,' বলেন তিনি।
নির্বাচনে কতগুলো আসনে এনসিপি অংশগ্রহণ করবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্যরা বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তারা কতগুলো আসনে নির্বাচন করবেন।
'৩০০টি আসনে করব না ২০০টি আসনে করব, সেটি আমরা পরবর্তীতে জানাব,' বলেন তিনি।
অন্য দলের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, 'নির্বাচনের তফসিল কখন হবে, সেটিও বিষয়। তখন আমরা জোট, আসন নিয়ে চিন্তা করতে পারব।
'এই মুহূর্তে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে। তবে সেখানে নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারের বিষয়বস্তু প্রাধান্য পাচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে আমাদের নির্বাচনি অবস্থান ও কৌশল গ্রহণ করা হবে।'
সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছে এনসিপি
নিবন্ধ পাওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এনসিপি ১৬ জুন পর্যন্ত ক্রীড়া, পরিবেশ, আইন, আইসিটিসহ ১৩টি সেল গঠন করেছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত জানান, দলটি প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসকসহ ১০টি উইং তৈরি করেছে। ৩০টি জেলা কমিটি, ১২০টি উপজেলা ও ২টি মহানগর কমিটিও গঠন করেছে।
এছাড়াও গত ৪ জুন দলটি আর্থিক ও তহবিল পরিচালনা নীতিমালা প্রকাশ করেছে।
প্রতীকের বিষয়ে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, দল গঠনের আগে 'আমার বাংলাদেশ' ক্যাম্পেইন ও দলীয় ফোরামে কয়েকটি অপশন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনে আবেদনের পর সেটি জানানো হবে।'
সূত্র জানিয়েছে, দলীয় প্রতীকের সংক্ষিপ্ত তালিকায় মুষ্টিবদ্ধ হাত, দোয়াত-কলম, ল্যাপটপ, শাপলাসহ 'পাঁচ-ছয়টি' প্রতীক রাখা হয়েছে।
জুনের শুরুতে ঢাকার দুই মহানগরীতে কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক কমিটি দেওয়া শুরু করে এনসিপি। এরপর ঈদের আগে ধাপে ধাপে পঞ্চগড় সদর, তেতুলিয়া, দেবীগঞ্জ, বোদা, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া, নড়াইলের লোহাগড়া, কালিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর, সরাইল, বাগেরহাটের কচুয়াসহ শতাধিক উপজেলার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
জেলার মধ্যে শরণখোলা, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি, মেহেরপুর, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, লালমনিরহাট, নড়াইল, চুয়াডাঙা ও মুন্সিগঞ্জে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ঈদের পর বান্দরবান, বগুড়া ও জামালপুর ও টাঙ্গাইলের আরও কয়েকটি উপজেলায় কমিটি গঠন করে দলটি।
সারজিস আলম বলেন, 'নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ করেই আমরা কমিশনে যাব। এক্ষেত্রে তাদের অন্য কোনো পন্থা বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই।'
তবে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ও আচরণে সংস্থাটির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিদ্যমান আইন-বিধি অনুযায়ী, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে ১০টি তথ্য আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। নিবন্ধন ফি হিসেবে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, যা ফেরতযোগ্য নয়।
দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতিও জমা দিতে হয়। এছাড়াও তহবিলের উৎস, দল নিবন্ধনের আবেদনকারীর ক্ষমতাপত্র, নিবন্ধন ফি বাবদ অফেরতযোগ্য ট্রেজারি চালানের কপি এবং নিবন্ধনের তিনটি শর্তের মধ্যে যেকোনো একটি পূরণের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়।