অপ্রচলিত দেশি ফল নিয়ে ঢাকায় জাতীয় ফল মেলা

একসময় দেশের আনাচে-কানাচে নানা প্রজাতির ফল হতো। গ্রামে-গঞ্জে দেখা মিলত আতা, শরিফা, বিলম্বি, করমচা, বিলাতি গাব ও কাউফলের মতো অপ্রচলিত সব ফলের। অতিমাত্রায় নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় এসব ফল প্রায় হারাতে বসেছিল। তবে কৃষিবিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় এখন বিভিন্ন জায়গায় এসব ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ করছেন কৃষকরা। ফলে এসব ফলের চাহিদা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যেও।
অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় নানা ফলের দেখা মিলল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে (কেআইবি) আয়োজিত জাতীয় ফলমেলায়। বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি মেলায় স্টল দিয়েছে কৃষিসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের স্টলে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফলের প্রদর্শনী হয়েছে। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়াটা মেলাটি চলবে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।
শুক্রবার মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা যায়, নানা জাতের দেশি ফলে দিয়ে সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) স্টল। কাউফল, করমচা, ডেউয়া, আঁশফল, গাব, যজ্ঞডুমুর, চাম্বুল, আতা ফল, ডুমুর, চালতা, অরবরই, বিলিম্বি, শরিফা, সাতকরা, তৈকর, ডেফল, লুকলুকি, বৈচি, মুনিয়ার মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রায় অর্ধশতাধিক ফল এ স্টলে শোভা পেয়েছে। এছাড়াও আম, কলা, জামরুল, লেবু, অ্যাভাকাডো, লিচু, জামসহ দেশি-বিদেশি পরিচিত ফলও রয়েছে।
বিএডিসির উপপরিচালক ড. বশির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের পাশাপাশি আমাদের দেশে বিভিন্ন ফলেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে কিছু সময় অনেক ফল হারিয়ে যেতে বসেছিল। আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় সেগুলো এখন আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। আমাদের এগ্রো সার্ভিস সেন্টারগুলোতে এগুলোর সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে।'

মেলার মাঝখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) স্টলে প্রায় ৬০ প্রজাতির আমের প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: বিশ্বনাথ চ্যাটার্জি, গৌড়মতী, কালোপাহাড়, কুয়াপাহাড়ি, রানীপছন্দ, মল্লিকা, ক্ষীরশাপাতি, আনন্দপুরি, বাদশাভোগ, গ্রেট বোম্বাই ইত্যাদি। এছাড়া প্রায় শতাধিক দেশি ফলের সমাহার দেখা গেছে অধিদপ্তরের স্টলে। এরমধ্যে বেতফল, তিশা, মটমটিয়াসহ অনেক অপ্রচলিত ফলও রয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রায় ১৩০ ধরনের অপ্রচলিত ফল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ধরনের ফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে এবং স্বল্প পরিসরে চাষও হয়। অপ্রচলিত ফল উৎপাদন ও সম্প্রসারণে ২০২০ সালে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি হাতে নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় অনেক ফলকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর প্রভাবেই বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন অপ্রচলিত ফল পাওয়া যাচ্ছে।
তারা বলছেন, বিলুপ্তপ্রায় বা অপ্রচলিত ফলগুলো আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। এ কারণে এসব ফল চাষে খুব বেশি চ্যালেঞ্জ নেই। আবার রোগবালাইও হয় কম। এসব ফলের নতুন জাত উদ্ভাবন করা গেলে কৃষক এসব ফল চাষে আরো আগ্রহী হবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো: আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, 'প্রচলিত ও অপ্রচলিত বিভিন্ন ফল আমাদের প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে। বেশিরভাগই আমাদের হর্টিকালচারগুলোতে উৎপাদন হয়েছে। মানুষের ভালো সাড়া পাচ্ছি মেলায়।'
কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত এবারের ফল মেলায় ২৬টি সরকারি ও ৪৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। বিভিন্ন স্টলে ফল চাষে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, উচ্চফলনশীল জাত এবং রাসায়নিকমুক্ত উৎপাদনের উদাহরণও দর্শনার্থীর জন্য তুলে ধরা হচ্ছে।
শুক্রবার ছিল তিনদিনব্যাপী এ মেলার দ্বিতীয় দিন। মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা বিথী আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'অনেক ফল এখানে এসে দেখছি, যেগুলো এর আগে নামও শুনিনি। এগুলো যে আমাদের দেশীয় ফল সেটা জেনেই অবাক হচ্ছি। আমি ছাদ বাগানে কয়েকটি গাছ লাগাব।'
ঘুরতে আসা আরেকজন জুবায়ের রহমান বলেন, 'ভৌগলিকভাবে আমাদের বৈচিত্র্যময় অনেক ফল রয়েছে, যেগুলো আমাদের পুষ্টি জোগাবে। কিন্তু এসব ফলকে আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না। বিদেশি ফলের চেয়ে এসব ফলে নজর দেওয়া উচিত। সরকারের উচিত এসব ফলের সম্প্রসারণ করা।'
মেলায় প্রদর্শনীর পাশাপাশি আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল বিক্রি করছেন উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন জাতের আম। মেলার বিভিন্ন স্টলে হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা, নাক ফজলি, আম রুপালি ও বারি-৪ জাতের আম ৬০-১০০ টাকা এবং ব্যানানা আম প্রতিকেজি ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বেদানা লিচু (১০০টি) ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, চায়না-৩ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ১৩০-২০০ টাকা ও জাম বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কমে যাওয়ায় একপ্রকার লোকসান দিয়েই তারা আম বিক্রি করছেন। এছাড়া বৃষ্টিপাতের কারণে মেলায় মানুষের অংশগ্রহণ কম।
রাজশাহী থেকে মেলায় আসা বিক্রেতা কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিকেজি আমে রাজশাহী থেকে আনতে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ প্রায় ২০ টাকা পড়েছে। এরপর অন্যান্য আরও খরচ আছে। যে দামে এখন আম বিক্রি করছি, এরচেয়ে বাগানে বিক্রি করলে লাভ হতো বেশি।'
রাজশাহীর গোদাগাড়ি থেকে আসা মো. তারিক হাসান বিভিন্ন জাতের ৪০ মণ আম নিয়ে এসেছেন মেলায়। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ১০-১২ মণ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, 'আমের দাম অনেক কম। ভেবেছিলাম, মেলায় ভালো দাম পাওয়া যাবে। এখন লোকসানে পড়তে হবে।'
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে শনিবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে।