চার মাসের সংলাপ, ৫০ অধিবেশন শেষে ঐকমত্য শুধু দুই সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে

গত ফেব্রুয়ারি থেকে চার মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার-সংক্রান্ত সুপারিশ নিয়ে সংলাপ করে আসছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম ধাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশন এবং দ্বিতীয় ধাপে উদ্বোধনী আলোচনাসহ দিনব্যাপী ৫টি সংলাপসহ মোট ৫০টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতগুলো সংলাপের পরও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত এসেছে শুধু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়ে।
আলোচনার ধীরগতির কারণে 'জুলাই সনদ' নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই এ কাজ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রিয়াজ।
৬ মাস মেয়াদী ঐক্যমত কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন–বিষয়ক বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা হবে।
কমিশনের আলোচনায় এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা হলো—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংস্কার এনে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। তবে বিএনপি এখানে 'ভিন্নমতের নোট' দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, তারা যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে সংবিধান সংশোধনী ও জাতীয় নিরাপত্তা (যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি) বিষয়ক সিদ্ধান্তও এই অনুচ্ছেদের আওতায় আনবে।
এছাড়া, পাবলিক একাউন্টস, প্রিভিলেজ, এস্টিমেট ও আন্ডারটেকিংস—এই চারটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলের হাতে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও আরও কয়েকটি দল আসনসংখ্যার ভিত্তিতে আরও বেশি কমিটিতে সভাপতির পদ দাবি করেছে।
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও নারী আসন বাড়ানো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হলেও, এই দুটি ক্ষেত্রেই নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে তারা এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
এছাড়া জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগে পরিবর্তনের বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও কয়েকটি দলের আপত্তির কারণে এখনো নীতিগত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।

আলোচনার অগ্রগতি প্রসঙ্গে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, 'আলোচনা ভালো হচ্ছে, আপ্যায়নও ভালো হচ্ছে, কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এনসিসি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু ঐকমত্য আসেনি।'
তিনি বলেন, 'জনগণ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। রাষ্ট্রের এত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু ফল হচ্ছে না। বড় দলের দায়িত্ব বেশি। তারা যদি এই প্রক্রিয়া পরিবর্তন না চায়, তাহলে কোনো পরিবর্তন হবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'ঐকমত্য কমিশনেরও দায় আছে। তারা যদি ভিন্নমত পোষণকারী দলগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করত, তাহলে এত দীর্ঘায়িত হতো না।'
কমিশনের সহসভাপতি আলী রিয়াজ বলেন, 'সব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে না। আমরা কিছু জায়গায় একমত হব, বাকিগুলো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।'
তিনি বলেন, 'আমাদের সময় সীমিত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী কাজ করছে, তা জানতে জনগণের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেই আগ্রহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানান।
মৌলিক সংস্কারে অনমনীয়তার অভিযোগ
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনসহ কমিশনের বিভিন্ন আলোচনায় বিএনপির বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ করেছে এনসিপিসহ কয়েকটি দল।
কমিশনের আলোচনায় বিএনপি তাদের লিখিত অবস্থানে অনড় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের প্রস্তাবের বাইরে বহু প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। বিচারব্যবস্থা, ম্যাজিস্ট্রেসি, দুদক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা আংশিকভাবে ও সম্পূর্ণভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছি।'
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, 'কিছু দল মনে করে তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাবে এবং ক্ষমতার কাঠামো নিজেদের মতো করে সাজাতে পারবে। কিন্তু এমন একটি কাঠামো, যেটি জনগণের সমর্থন পায় না, তা টিকে থাকতে পারে না।'
তিনি আরও বলেন, 'অতীতে রাষ্ট্রকাঠামোয় ত্রুটি থাকার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যারা আলোচনায় অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে, তারা বাস্তবতা আমলে নিচ্ছে না।'
এনসিসি আলোচনা নিয়ে হতাশা
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) বিষয়ক আলোচনায় বিএনপির বিরোধিতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, 'আমরা যে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছি, তাতে এনসিসি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমরা আশা করেছিলাম জাতীয় স্বার্থে এ বিষয়ে ঐকমত্য হবে। কিন্তু তা হয়নি। যারা বিরোধিতা করেছে, তারা কোনো বিকল্প প্রস্তাব দেয়নি। আগে যারা এনসিসির পক্ষে ছিল, তারাও এখন কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে বিরোধিতা করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ করা হয়েছে। একসময় বিরোধী দলে থাকা দলগুলো এই আইনগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এখন তারা কোনো বিকল্প প্রস্তাব না দিয়েই আপত্তি জানাচ্ছে।'
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, 'এনসিসিকে অনেক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে, কিন্তু কোনো জবাবদিহিতা নেই। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে থাকতে পারি না, যেখানে ক্ষমতা আছে কিন্তু জবাবদিহিতা নেই।'
আলী রিয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, 'সাংবিধানিক নিয়োগের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার বলে অধিকাংশ দল মত দিয়েছে। তবে দুই-একটি দল এ বিষয়ে মতভেদ জানিয়েছে।'