এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর উপস্থিতি কম হলেও স্বস্তির সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। থেমে থেমে বৃষ্টি, মশা নিধনে জোর না দেওয়ার কারণে চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ঢাকার বাহিরে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু সর্বোচ্চ হয়েছে। তবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনুযায়ী এডিস মশা নিধনে কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা ড. কবিরুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের যে সার্ভে চলে সেখানে আমরা দেখেছি গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি। আবার এ বছর রোগীও বেশি। একদিকে মশার ঘনত্ব বেশি, রোগী বেশি এটা থেকে মনে হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এটাই এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময়। যে কোনো সময়ে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। যদিও আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই তিন মাস ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ ঝুঁকির সময় হিসেবে ধরা হয়।'
তাছাড়া শুধু ঢাকা না ঢাকার বাইরেও কিছু কিছু জেলাতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, 'বরিশাল, বরগুনা, চাঁদপুর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম এ কয়েকটি জেলাতে আমরা এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাচ্ছি। এ জেলাগুলোতে গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'এডিস মশার ব্রিডিং সোর্স ধ্বংস করতে হবে। যেসব জায়গায় জনবলের ঘাটতি আছে তা মিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। জনসাধারণকে নিজের বাড়ি, বাড়ির আঙ্গিনায় পানি যাতে না জমে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছরে মে মাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে রোগী আক্রান্তের হার জুন মাসে সবচেয়ে বেশি। জুনের ১৫ দিনে ১৬৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগে এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে জানুয়ারি মাসে এক হাজার ১৬১ জন। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে যথাক্রমে ৩৭৩, ৩৩৬ ও ৭০১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এ বছর ১৫ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৯৮৮ জন ও মারা গেছেন ৩০ জন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ পুরুষ ও ৪১ শতাংশ নারী। ডেঙ্গু আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি রোগী বরিশাল বিভাগে দুই হাজার ৭২৩ জন এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে মাত্র ২১ জন।
এডিস মশার বিস্তার শুরু হয় সাধারণত জুন মাসে। এসময় বৃষ্টিতে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে লার্ভা জমে। বৃষ্টির পর তাপ বাড়লে এই পানিতে জমে থাকা এডিসের ডিম দ্রুত পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপ নেয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস রোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন টিবিএস-কে বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়ার আশঙ্কা আছে। গত বছরের তুলনায় মশার প্রকোপ বেশি। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।
তিনি আরো বলেন, 'প্রতি বছর ডেঙ্গুতে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু এটাতো এমন না যে প্রতিরোধ করা যায় না। এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সে ধরনের চিকিৎসা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমাদের জানা আছে। এটাতো কোনো অজানা রোগ না। ডেঙ্গুকে জরুরি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবাইবে এক যোগে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাজেট বাড়াতে হবে। ছাত্রদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে, তারা মশক নিধনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩,২১,১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয় ১,৭০৫ জনের। ২০২৩ সালেও ১৫ জুন পর্যন্ত দেশের মোট ডেঙ্গু রোগী ছিলো ৩,১৪৮ জন এবং মৃত্যু ছিলো ২৪ জনের। আর ২০২৪ সালে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিলো ৩,২০৭ জন ও মৃত্যু ছিলো ৪০ জনের।
এ বছর ১৫ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৯৮৮ জন ও মারা গেছেন ৩০ জন।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ পড়াতে চলা আন্দোলনের কারণে নগর ভবনে গত এক মাস ধরে তালা ঝুলছে। ফলে নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও মশক নিধন কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে না বলে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার ঢাকার বাহিরের পৌরসভা কিংবা উপশহরগুলোতে মশক নিধন জোরদার করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।