নির্বাচনের দিকে মনোযোগ বিএনপির—কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত চলছে প্রস্তুতি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনয়স ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বিবেচনায় নিয়ে এখন পুরো ভোটের প্রস্তুতিতে মনোযোগী বিএনপি।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, প্রায় আড়াই দশক আগে, ২০০১ সালে সর্বশেষ সরকার গঠন করা বিএনপি গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের থেকেই মাঠপর্যায়ে নতুন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে।
দলটি মনে করছে, সরকার আন্তরিক হলে 'জুলাই সনদ' ঘোষণা, ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করা—এসব কাজ আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কোনো সমস্যা থাকবে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় তৃণমূল পর্যায়ে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ভোটকেন্দ্র কমিটি করার নির্দেশনা ছিল। সে হিসাবে দলের নেতাকর্মীরা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।
এখনও যেসব এলাকায় ভোটকেন্দ্র কমিটি গঠনের কার্যক্রম বাকি রয়েছে, জুলাইয়ে মধ্যে সেগুলো সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে।
বিএনপির হাইকমান্ড সূত্র বলছে, আগমী ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনমত তৈরি করতে কয়েক মাস কাজ করেছে দলটি।
শুধু 'ক্লিন ইমেজধারী' প্রার্থীদের মনোনয়ন
বিএনপির কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাইসহ নির্বচানি মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে দলের কেন্দ্র ও তৃণমূল। একটি সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে 'ক্লিন ইমেজধারী' প্রার্থীদের প্রাধান্য দেবে বিএনপি। অপকর্মে জড়িত বা বিতর্কিত কাউকে মনোনয়ন দেবে না দলটি।
২০১৮ সালের নির্বাচনে দল থেকে যাদের চূড়ান্ত প্রার্থী করা হয়েছিল, যারা দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগপর্যন্ত, বিশেষ করে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী ব্যক্তিদের দিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকার খসড়া তৈরি করা হবে।
আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যে এই খসড়া তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে 'গ্রিন সিগন্যাল' না দিলেও দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বসে নেই। নির্বাচনি এলাকায় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন তারা, আছেন গণসংযোগের মধ্যে। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী টিবিএসকে বলেন, 'বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে এই দলটি একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। সুতরাং, নির্বাচনের জন্য সবসময় বিএনপির প্রস্তুতি থাকে।'
'এখন নির্বাচেনের জন্য সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপি প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। সেই কাজ চলমান।'
'বগুড়ার লোকজন ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে'
বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া জেলার নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের সবার দৃষ্টি আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা টিবিএসকে বলেন, 'বগুড়ার ভোটের মাঠ পুরোই প্রস্তুত। লোকজন বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। নির্বাচন কমিশন শিডিউল ঘোষণা করলেই নির্বাচনের পুরো আমেজ তৈরি হয়ে যাবে।'
শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি মীর শাহে আলম টিবিএসকে বলেন, বগুড়া-২ আসনে ১১০টি ভোটকেন্দ্রে তারা পৃথক কমিটি গঠন করেছেন। প্রত্যেক কমিটির সদস্যসংখ্যা ১০১ জন করে। তারা দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া, ভোটের কার্যক্রম পরিচালনা ও ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন।
'লক্ষ্য এখন দৃষ্টিসীমায় চলে এসেছে'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের মানুষ বহুদিন ধরে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিল। এখন সেই প্রত্যাশিত লক্ষ্য দৃষ্টিসীমায় চলে এসেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের প্রশংসা করে সালাহউদ্দিন বলেন, লন্ডনের বৈঠকে দুজনে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, ফলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
দলীয় সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বাস্তবতা বিবেচনায় বিএনপি প্রতিটি আসনে প্রাথমিকভাবে তিন থেকে চারজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। কারণ, বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতে দেওয়া হবে কি হবে না, দল তখন এমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। তাই প্রথম প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হলে দ্বিতীয়জন নির্বাচন করবেন; দ্বিতীয়জনের প্রার্থিতা বাতিল হলে, পরেরজন নির্বাচন করবেন—এমন চিন্তা-ভাবনা থেকে দলীয় কৌশলের অংশ হিসেবে তখন এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
তবে একাধিক সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ২০১৮ সালের মতো কিছু ঘটবে না বলেই বিশ্বাস বিএনপির। আগামী নির্বাচনে দলীয়ভাবে একজনকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। একইসঙ্গে দলীয় সেই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বাকিদের কড়া নির্দেশনাও দেওয়া হবে, যাতে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন।