পোস্তার আড়তে সুশৃঙ্খলভাবে চামড়া সংগ্রহ, নষ্ট চামড়া এসেছে কম

পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার পোস্তার কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে মাঠপর্যায়ে তুলনামূলক শৃঙ্খলা থাকায় আড়তগুলোতে নষ্ট চামড়া কম এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার নষ্ট চামড়া অনেক কম। সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ লবণ বিনামূল্যে বিতরণ ও চামড়া ব্যবস্থাপনায় উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের ফলে এ সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন তারা।
বুধবার (১১ জুন) পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তে গিয়ে দেখা যায়, লবণযুক্ত চামড়া সুন্দরভাবে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, নষ্ট চামড়া ছাড়া পোস্তায় আনা সব চামড়াই ট্যানারিতে বিক্রি হয়েছে।
পোস্তা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বৃহৎ জায়গা। এখানে এ বছর বড় ও মাঝারি গরুর চামড়া ৭০০–৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আকারে ছোট ও কিছুটা খারাপ মানের চামড়া ৬০০–৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, এবার পরিবেশ অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল ছিল। 'নষ্ট চামড়া চামড়া ছাড়া সব চামড়াই আমরা কিনেছি,' বলেন তিনি।
টিপু বলেন, পোস্তার ৪০টি পাইকারি আড়ত ৭০–৭৫ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৫–-২০ শতাংশ কম।
এদিকে আজ থেকে ঢাকার ভেতরের লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করেছেন সাভারের ট্যানারি মালিকরা। ঢাকার বাইরের চামড়া কেনা শুরু করবেন আরও এক সপ্তাহ পরে।
এ বছর ৮০–৮৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শাখাওয়াত উল্লাহর সঙ্গে বুধবার এই প্রতিবেদকের দেখা হয় লালবাগের পোস্তায়। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সরাসরি প্রায় ৩ লাখ ৮৭ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছি। ঢাকার ভেতরে আজ [বুধবার] থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করব আমরা। ঢাকার চামড়া এক সপ্তাহের মধ্যে সংগ্রহ শেষ করব। এক সপ্তাহ পর ঢাকার বাইরের চামড়া কেনা শুরু করব। দুই থেকে আড়াই মাস লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ করব।'
তিনি আরও বলেন, 'এ বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি পিসের মতো চামড়া সংগ্রহ। তবে সেটা হবে না। এবার ৮০ থেকে ৮৫ লাখ পিস সংগ্রহ হতে পারে।'
শাখাওয়াত বলেন, যারা সঠিকভাবে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেছেন, তারা সরকার-নির্ধারিত দাম পাবেন। আর যারা লবণ দিতে দেরি করে চামড়া নষ্ট করেছেন, তারা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হবেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্পনগরীতে কঠিন বর্জ্যের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় বাংলাদেশ লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না। সে কারণে এই খাত থেকে রপ্তানি বাড়ছে না।
বিটিএ সূত্র বলছে, বর্তমানে হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্পনগরীতে ১৪২টি ট্যানারি উৎপাদনে রয়েছে।
শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, 'সাভারে ট্যানারি শিল্পনগরীতে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে আজকে চামড়া খাতের এই দুর্গতি। চামড়া শিল্পনগরীতে আমাদের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন হুমকির সম্মুখীন। এদিকে সরকারের আরও নজর দেওয়া প্রয়োজন।'
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চামড়া খাত থেকে দেশের রপ্তানি আয় এসেছিল ১.০৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই সেই অঙ্ক অতিক্রম করে রপ্তানি হয়েছে ১.০৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, এবারের ঈদে দেশে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ লাখের বেশি গরু/মহিষ, ৪৪ লাখের বেশি ছাগল/ভেড়া এবং অন্যান্য প্রাণী রয়েছে প্রায় ১ হাজার।
সরকার এ বছর লবণযুক্ত বড় গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৬০–৬৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ছোট গরুর প্রতি পিস চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ঢাকায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা। খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ২২–২৭ টাকা ও বকরির চামড়ার দাম ২০–২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সরকারের পদক্ষেপ কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়া রোধ করেছে
এ বছর চামড়া সংরক্ষণের জন্য মাদ্রাসা ও এতিমখানায় সাড়ে ৭ লাখ মণ লবণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন।
এছাড়া ঈদুল আজহায় কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং কোরবানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য বাণিজ্য উপদেষ্টাকে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল। এতেও চামাড়া সংরক্ষণ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
নষ্ট হওয়া এড়াতে সরকার ঈদের দিনসহ পরবর্তী ১০ দিন অন্য জেলা থেকে ঢাকায় কাঁচা চামড়া পরিবহন নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ, ট্রাকে ঢাকায় চামড়া নিয়ে আসার সময় যানজটে আটকে থাকায় অনেকসময় চামড়া নষ্ট হয়ে যায়।
বিটিএ চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, এবার যেভাবে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের ব্যবস্থাপনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে, এতে সার্বিকভাবে চামড়ায় লবণ দেওয়ার প্রক্রিয়া ভালো হয়েছে।
তিনি সাভার চামড়া শিল্পনগরীতেও কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একই ধরনের কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। সাভার চামড়া শিল্পনগরীতেও কোনো স্থায়ী কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই।
তবে সরকার এত ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বেশ কিছু জায়গায় নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয়নি, এমন অভিযোগ এসেছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, 'ঈদের দিন একসঙ্গে লাখ লাখ চামড়া বাজারে আসে। ব্যবসায়িক রীতি অনুসারে পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। চামড়ার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা এই প্রথমবারের মতো সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মাদ্রাসাগুলোতে চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিপুল পরিমাণ লবণ সরবরাহ করেছিলাম। কোরবানির অধিকাংশ চামড়া যেহেতু মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে বাজারে আসে, তারা চামড়া সংরক্ষণ করে কিছুদিন মজুত করলে চামড়ার সরবরাহ কম হতো, দাম বেশি পেত। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তবু গরুর চামড়ার দাম অনেক বছরের মধ্যে এবার বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।'