মেড ইন হাজারীবাগ: চামড়ার তৈরি পণ্যের হাব হয়ে ওঠার গল্প

বুড়িগঙ্গার পানি কালচে; গন্ধও বিকট। অবশ্য এর পেছনে হাজারীবাগের ৭০ বছরের পুরনো ট্যানারি শিল্পের একটা যোগসাজশ ছিল। তবে ২০১৮ সালে এ ট্যানারি স্থানান্তর করা হয় সাভারের হেমায়েতপুরে। এতে বুড়িগঙ্গার যেন কিছুটা স্বস্তি মেলে। সেইসঙ্গে বদলাতে শুরু করে হাজারীবাগের চেহারাও।
তবে ট্যানারি স্থানান্তরের সাত বছরের মধ্যে হাজারীবাগ নামটি যে আবারও অনেকের মুখে মুখে শোনা যাবে, সেটা কেউ হয়ত ভাবেনি।
এক সময় যে এলাকা ছিল দুর্গন্ধময় ও কারখানার বর্জ্যে ভরা, আজ সেই এলাকা দেশের চামড়াজাত পণ্যের জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য গন্তব্য। এখানকার পণ্য ইতোমধ্যে সবার নজর কেড়েছে। ফলে অনেকের কাছে কম দামে চামড়াজাত পণ্য কেনার গন্তব্য এই হাজারীবাগ!
ট্যানারি থেকে চামড়ার পণ্য
কাঁচা চামড়া ব্যবহার উপযোগী করতে ঝক্কি-ঝামেলা কম নয়। এছাড়া পরিবেশ দূষণের শঙ্কা তো রয়েছেই। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে বহু মানুষের অসুবিধার কারণ ছিল এ ট্যানারি। তাই এটা স্থানান্তরের পর হাজারীবাগ যেন হাপ ছেড়ে বেঁচেছে, এমনটাই মনে করেন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক।
কিন্তু জায়গাটা তো আর খালি পড়ে থাকবে না। ট্যানারি স্থানান্তরের পরপরই এই এলাকায় চামড়াজাত পণ্য তৈরির বিভিন্ন কারখানা চালু হয়।
মোহাম্মাদ শাওন পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণের কাজ করতেন। বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৮ সালে। ট্যানারি স্থানান্তরের পর তিনি বেকার হয়ে পড়েন। সে সময় তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু চামড়া নিয়েই তার জানাশোনা ও দক্ষতা, তাই চামড়ার তৈরি পণ্যের একটা দোকান দেওয়া যায় কি না। এ এলাকায় কিছু জুতার দোকান আগে থেকেই ছিল। নতুন করে চামড়ার পণ্যের আরও কিছু দোকান সে সময় চালু হচ্ছিল।

তবে দোকান করার এই ভাবনা বাস্তবায়ন খুব একটা সহজ ছিল না শাওনের জন্য। শুরুতে শ্রমিক হিসেবে এখানে-ওখানে কাজ করেছেন কিছুদিন। স্থানীয় এক দোকান মালিকের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। সেই সুবাদে একটি দোকান পেয়ে গেলেন অর্ধেকেরও কম ভাড়ায়। ২০২২ সালে ব্যবসা শুরু হলো। ডিএমডি লেদার গুডস নামের দোকানটি নিয়ে শুরু করলেন ব্যবসা। এখন শাওন হাজারীবাগের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী।
শাওনের মতোই গল্প হাজারীবাগের অসংখ্য দোকান মালিকের। এক সময় যারা ছিলেন শ্রমিক, এখন তাদের অনেকেই জুতা তৈরির কারাখানার মালিক। আর তাদের কারণেই চামড়ার পণ্যের নির্ভরযোগ্য একটি নাম হয়ে উঠেছে হাজারীবাগ। দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও এখানকার নাম ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতই।
মেড ইন হাজারীবাগ
শের-ই-বাংলা রোডের দুপাশ ধরে সারি সারি দোকান। প্রতিটি দোকানই প্রায় চামড়াজাত পণ্যের। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি চায়ের দোকান। দোকানগুলোর বাইরে থেকে দেখা সারি সারি জুতা। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চামড়ার গন্ধও নাকে আসে মাঝেমধ্যে।
হাজারীবাগের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি রেজা খালেদ জানান, তাদের সমিতির অধীনে এখানে দোকান রয়েছে ১৬০টি। নতুন নতুন দোকান হচ্ছে। মার্কেটও হচ্ছে একাধিক। এখানকার জুতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় 'মেড ইন হাজারীবাগ' কথাটি! এখানকার দোকানগুলোর জুতা সারাদেশে হাজারীবাগের জুতা নামে পরিচিত।

'এটা মনে হয় বাংলাদেশের একমাত্র মার্কেট যেখানে পুরোটা লেদারের পণ্য। অন্য কিছু আপনি পাবেন না। একটা কাপড়ের দোকানও এখানে নাই। সবগুলো জুতার দোকান। আর একদম পিওর লেদার', বললেন রেজা খালেদ।
এও জানালেন, আসল চামড়ার তৈরি পণ্য বিক্রি করতে হবে- সমিতির পক্ষ এ নির্দেশনাও দেওয়া আছে৷ তবে যদি শিশু বা নারীদের কোনো পণ্যে কৃত্রিম চামড়া অথবা রেক্সিন ব্যবহার করা হয়, সেটাও দোকানে উল্লেখ থাকতে হবে। এ সততাই হাজারীবাগের জুতাকে সুনাম এনে দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
'২০২১ সালে এখানে দোকান ছিল ৬০টি। আর এখন দ্বিগুণের বেশি। মানুষ ভরসা করছে আমাদের প্রতি। শত শত মানুষ অনলাইনে এ পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন', বলেন রেজা খালিদ।
তিনি জানান, সাভারের হেমায়েতপুর থেকে আসে প্রক্রিয়াজাত চামড়া। এখানে এসে আরও কিছু প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। তারপর যায় বিভিন্ন কারখানায়। এখানকার বেশিরভাগ দোকানেরই নিজস্ব কারখানা রয়েছে। যেগুলোর নেই, সেগুলো এখানকার কারখানা থেকে পণ্য সংগ্রহ করে।

আছে চামড়ার বেল্ট, ব্যাগ, মানিব্যাগ, চাবির রিং...
৪০ বছর বয়সি মোহাম্মাদ কামাল হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এক শুক্রবার বিকেলে তিনি হাজারীবাগে একজোড়া জুতা ও দুটি বেল্ট কিনতে যান। তিনি বলছিলেন, সহকর্মীদের কাছে হাজারীবাগের বেশ সুনাম শুনেছেন। এদিক দিয়েই একটা কাজে যাচ্ছিলেন। হাতে সময় থাকায় কেনাকাটাও সেরে ফেলছেন।
ইউনিক লেদারের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মাদ আকিব জানান, তাদের মূল ক্রেতা অফিস যাতায়াত করা মানুষেরা। এছাড়া ক্রেতাদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী। তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই পণ্য তৈরি করা হয়।
পুরো মার্কেট ঘুরে সব দোকানেই প্রায় একই ধরনের পণ্যের দেখা পাওয়া গেল। যদিও চামড়ার জুতা ও স্যান্ডেলই এখানকার প্রধান আইটেম, তবে কোনো কোনো দোকানে অন্যান্য পণ্যের প্রাধান্য রয়েছে।

জুতার মধ্যেও অনেক ধরন রয়েছে। রয়েছে দামেও ভিন্নতা। টার্সেল ও নাগরা জুতার দাম শুরু হয় ৮০০ টাকা থেকে। মানভেদে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় এসব জুতা।
স্যান্ডেলেরও রয়েছে বড় কালেকশন। ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় মধ্যে বিক্রি হয় হাওয়াই স্যান্ডেল। আর ভালোমানের বুট জুতা বিক্রি হয় দুই হাজার টাকায়।
যাদের লোফার পছন্দ, তারাও এক হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে পছন্দের লোফার কিনতে পারবেন। আর ফরমাল ও স্টাইলিশ জুতা বিক্রি হয় দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়। সাড়ে ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে মিলবে ভালো চামড়ার বেল্ট।
এসব ছাড়াও চামড়ার বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ এখানে পাওয়া যায়, দাম দেড় হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। ৫০০ টাকায় পাওয়া যাবে মানিব্যাগ। চাবির রিং এর দাম শুরু ১০০ টাকা থেকে। বিক্রেতারা আল মামুন জানালেন, ক্রেতারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে দামাদামি করতে পারেন। অনেক পণ্যের সঙ্গেই আবার এক বছরের ওয়ারেন্টি দিয়ে থাকেন তারা। ফলে দিন দিন বিশ্বস্ততা বাড়ছে তাদের।
আকিবের মতে, সাশ্রয়ী দামের মধ্যে ভালো পণ্য পায় বলেই মানুষ এত ভালোবাসা দেখায়। তিনি বলেন, 'এত কম দামে অরিজিনাল চামড়ার প্রোডাক্ট আর কোথাও কেউ দিতে পারবে না।'

হাজারীবাগ থেকে বিশ্ববাজারে
হাজারীবাগের প্রায় প্রতিটি দোকান অনলাইনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর এসব দোকানের মূল ব্যবসাই হয় অনলাইন আর পাইকারি পণ্য বিক্রির মাধ্যমে। প্রায় ডজনখানেক দোকানে কথা বলে জানা গেল, অনেক বড় বড় ব্র্যান্ডের জুতাও তাদের এখানকার কেউ কেউ বানিয়ে থাকেন।
বড় বড় ব্র্যান্ডের নিজস্ব কারখানা থাকার পরেও হাজারীবাগ থেকে কেন পণ্য নেওয়া হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে আকিব বলেন, 'প্রতিটা ব্র্যান্ডেরই হাজারের ওপর আলাদা আলাদা ডিজাইন ও কালার কম্বিনেশন (আর্টকেল) থাকে। সবগুলো আর্টিকেল নিজেরা বানাতে পারে না। তখন হাজারীবাগের কারখানাগুলো থেকে প্রোডাক্ট নেয়। তবে চুক্তি থাকে যে ওই রকম ডিজাইনের পণ্য আমরা বানাতে পারব না বা ডিসপ্লেও করতে পারব না।'

শাওন জানালেন, বড় বড় ব্র্যান্ডই শুধু নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসেও তিনি পণ্য সরবরাহ করেন। অনেকে আবার গিফট আইটেম হিসেবে কাস্টমাইজড পণ্য বানিয়ে নেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোও তাদের থেকে চামড়ার পণ্য কিনে থাকে।
তিনি আরও বলেন, শত শত অনলাইন পেইজ হাজারীবাগের পণ্য দিয়ে চলে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয় এখানকার পণ্য। অনেক বাংলাদেশি নিজের উদ্যোগে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাকেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ১০৩৯.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর শুধু চামড়ার জুতা থেকেই এসেছেন ৫৪৪.০২ মিলিয়ন ডলার। এই আয়ের পেছনে হাজারীবাগের যে একটি বড় ভূমিকা, তা বলাই বাহুল্য!
যে কেউ চাইলে করতে পারেন ব্যবসা
'আপনি দোকানে আসবেন, প্রোডাক্টের ছবি তুলবেন, ফেসবুক পেইজে আপলোড দেবেন দামসহ। এর পর অর্ডার আসলে আমার থেকে পণ্য কিনে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেবেন', বললেন শাওন।
তিনি জানান, যে কেউ চাইলেই হাজারীবাগের পণ্য নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করতে পারবে।
'আমাদের থেকে পাইকারি কিনে, কিছুটা বেশি দামি অনলাইনে বিক্রি করেন অনেকে। আপনার কিছুই করতে হবে না। শুধু অন্যের প্রচারণা চালাবেন, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেবেন। অর্ডার আসলে পণ্য নিয়ে যাবেন', যোগ করেন শাওন।

ব্যবসায়ীরা জানান, হাজারীবাগের চামড়াজাত পণ্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। প্রতিটি দোকানের নিজস্ব ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে নিজেদের পণ্য উপস্থাপন করে থাকে। এতে সাড়াও মেলে বেশ। নিজেদের পাশাপাশি অন্যান্য অনলাইন ব্যবসায়ীদেরও উৎসাহিত করে থাকেন তারা। তাই যে কেউ চাইলেই হাজারীবাগের এসব চামড়াজাত পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন।
তবে শীতকাল আর ঈদুল ফিতর ছাড়া সারা বছরই খুচরা বাজার খানিকটা মন্দাই যায় হাজারীবাগের জন্য।
বিক্রেতাদের প্রত্যাশা, বছরের বাকি সময়টাতেও তাদের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠবে। আর সেটা সম্ভব বিদেশে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোর মাধ্যমে।
ছবি: জুনায়েত রাসেল