মুজিবনগর সরকার: মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার

মঙ্গলবার (৩ জুন) রাতে 'জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫' জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মুজিবনগর সরকারের সদস্য, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযুদ্ধকালীন আহতদের সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারীদের 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদের 'মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুধু সামরিক লড়াই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কূটনৈতিক প্রচারণাও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার– মুজিবনগর সরকার, সেই সংগ্রামের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সরকার।
মুজিবনগর সরকার গঠন
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে এই মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'মুজিবনগর'। দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় সরকারটি 'প্রবাসী মুজিবনগর সরকার' নামেও খ্যাত।
সরকার গঠনের দশদিন আগে, অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় সরকার। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে শপথ পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এম.এন.এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম.এন.এ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
১৮ এপ্রিল মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তিনি পাকিস্তানে আটক থাকায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। পাশাপাশি তিনি প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলি, পরিকল্পনা, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন। পাশাপাশি অন্যান্য যেসব বিষয় কারও ওপর ন্যস্ত ছিল না, সে দায়িত্বও পালন করেন।
পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এম মনসুর আলী স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
মুজিবনগর সরকারকে মোট ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি বিভাগ ছিল মন্ত্রিপরিষদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম ছিল সুসংগঠিত।
মুজিবনগর সরকার যেসব দায়িত্ব পালন করেছিল
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক কাঠামো: প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন এস.এ. সামাদ। যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন এম.এ.জি ওসমানী। তাকে সহায়তা করেন চিফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব, উপ-সেনাপতি এ.কে. খন্দকারসহ চিকিৎসা ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তারা। যুদ্ধক্ষেত্র ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটিতে এক একজন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়, তবে ১০ নম্বর (নৌ) সেক্টরের নির্দিষ্ট কমান্ডার ছিলেন না। গঠিত হয় তিনটি ব্রিগেড—জেড ফোর্স (মেজর জিয়াউর রহমান), কে ফোর্স (মেজর খালেদ মোশাররফ) ও এস ফোর্স (মেজর কে.এম. সফিউল্লাহ)।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক তৎপরতা: কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোমসহ বিভিন্ন শহরে মিশন স্থাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বার্তা পাঠানো হয় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের কাছে। কলকাতায় ছিলেন হোসেন আলী, দিল্লিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, ইউরোপে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ওয়াশিংটনে এম.আর. সিদ্দিকী, স্টকহোমে আবদুর রাজ্জাক।
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়: সচিবের দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার আসাদুজ্জামান। শিল্প ও বাণিজ্য কার্যক্রম সীমিত থাকলেও অর্থ বিভাগ 'বাংলাদেশ ফান্ড'-এ অর্থ সংগ্রহ করে ছয় মাসের বাজেট প্রণয়ন করে। তহবিল ব্যবস্থাপনায় গঠন করা হয় একটি কমিটি।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শুরুতে নিজে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন। পরে সচিব হিসেবে এইচ.টি. ইমাম দায়িত্ব নিলে সচিবালয়ের কাঠামো পূর্ণতা পায়।
সাধারণ প্রশাসন ও সংস্থাপন বিভাগ: নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরির নীতিমালা নির্ধারণে এই বিভাগ গঠন করা হয়। সচিব ছিলেন নূরুল কাদের।
জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিল: অভ্যন্তরীণ জেলাগুলো নিয়ে গঠিত হয় ১১টি প্রশাসনিক জোন। প্রতিটি জোনে চেয়ারম্যান হিসেবে একজন এমএনএ বা এমপিএ নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধকালীন ত্রাণ, শৃঙ্খলা ও জনসংযোগের দায়িত্ব ছিল এই কাউন্সিলের ওপর।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়: ডা. টি. হোসেনের নেতৃত্বে এ মন্ত্রণালয় চিকিৎসক দল প্রেরণ, ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের উপকরণ সংগ্রহে কাজ করে। যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করাই ছিল লক্ষ্য।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, চলচ্চিত্র, প্রকাশনা ও চারুকলার মাধ্যমে প্রচার ও মনোবল বৃদ্ধির কাজ পরিচালিত হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, গোয়েন্দা কার্যক্রম, পুলিশের মনোগ্রাম নির্ধারণ ও ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যুর দায়িত্ব পালন করে। আবদুল খালেক ছিলেন প্রথম আইজি, পরে সচিব হন।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ: ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি এবং উদ্বাস্ত্ত কল্যাণ বোর্ড।
সংসদ বিষয়ক বিভাগ: এমএনএ ও এমপিএদের সক্রিয় রাখার পাশাপাশি যুদ্ধকালীন জনমত গঠনে সহায়তা করে। সদস্যদের জন্য ভাতাও নির্ধারণ করা হয়।
কৃষি বিভাগ: যুদ্ধ-পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সীমিত কার্যক্রম চালায়।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া