মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুলকে খালাস দিলেন আপিল বিভাগ

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের আপিল গ্রহণ করে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় দেন।
এই রায়ের ফলে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তিতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাস নিয়ে আপিল বিভাগের রায় প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আদালতের এই রায়কে তারা মেনে নিয়েছেন এবং এতে আপত্তির অবকাশ নেই।
তিনি বলেন, 'এই মামলা যেহেতু রিভিউ থেকে আপিলে এসেছে, তাই এর ওপরে বাংলাদেশের আর কোনো আদালত বা আন্তর্জাতিক ফোরাম নেই। এই রায়ের মাধ্যমে বর্তমান বিচারপদ্ধতি আরও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে আর প্রশ্ন তুলতে পারবে না।'
তিনি বলেন, 'আমরা বরাবরই বলে আসছি, যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তাই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধের সংজ্ঞা এবং কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মতো বিষয়ের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। না হলে যে সমালোচনা আগে আমরা ট্রাইব্যুনালের রায়ে করেছিলাম, যে সেটি আন্তর্জাতিক মানসন্ধান পূরণ করে না, তা থেকেই যাবে।'
প্রসিকিউটর তামিম বলেন, 'আমরা যেদিন প্রসিকিউশনে যোগ দিয়েছি, সেদিনই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে আজ যখন আপিল বিভাগ বলেছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা এখানে প্রয়োজনীয়—আমরা তাতে একমত এবং এই রায়ের পক্ষেই আমরা রয়েছি।'
তিনি জানান, মামলার মূল যুক্তিগুলো (মেরিট) আদালতে উপস্থাপন করা হয় এবং সেগুলোর ভিত্তিতে আদালত আসামিকে খালাস দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর কোনো অবকাশ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে গাজী তামিম আরও বলেন, 'আমাদের দাখিল করা আবেদনে কিছু ক্লারিক্যাল ভুল ছিল, যা সংশোধন করে নতুন একটি আবেদন দাখিল করা হয়। সেখানে আমরা পরিষ্কারভাবে বলি, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় ও বিচার নিয়ে আপিল বিভাগ যেন ন্যায়বিচারের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন। সেক্ষেত্রে যেকোনো আদেশ দিলে আমরা তা মেনে নেব। আমরা ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যৎ বিচার ও বর্তমান কাঠামোর বিপক্ষে কোনো কিছু বলিনি, এমনকি কোনো আবেদনও দেইনি।'
এদিকে আজ সকাল সাড়ে ১১ টায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংবাদ সম্মেলনে রায় নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, 'এটিএম আজহারের রায় সুবিচার হয়েছে। মহান রবের দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদুলিল্লাহ।'
তিনি আরও বলেন, জুলুম করে দলটির ১১ জন শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজানো পাতানো আদালত এবং মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে কার্যত জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে নয়টি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে ২, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, ৫ নম্বর অভিযোগে ২৫ বছর এবং ৬ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন।
এরপর আপিলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। এ রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগে দণ্ড বহাল রাখা হয়, ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর একই বছরের ১৯ জুলাই এ টি এম আজহারুল ইসলাম রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২৩ পৃষ্ঠার একটি আবেদন করেন, যেখানে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়। প্রাথমিকভাবে আজহারুলের পক্ষে আবেদনটি করেন প্রয়াত অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও তার জুনিয়র মোহাম্মদ শিশির মনির।
শুনানি শেষে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ তাকে পূর্ণাঙ্গ আপিলের অনুমতি দেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে সার-সংক্ষেপ জমা দিতে বলেন। সে অনুযায়ী আপিল প্রস্তুত করা হয়।
আজ আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল হয়েছে।
এটি প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা, যেখানে রিভিউ পর্যায়ে এসে নতুন করে আপিল শুনানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।