এলএনজি সংকটে চট্টগ্রামে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি, বিপর্যয়ে শিল্প খাত

চট্টগ্রামে দৈনিক প্রায় ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে, যার ফলে শিল্প উৎপাদন এবং গৃহস্থালি ব্যবহারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জ্বালানি খাতের কর্মকর্তারা এই পরিস্থিতির জন্য পর্যাপ্ত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি না হওয়াকে দায়ী করছেন।
এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণরূপে আমদানি করা এলএনজি-র ওপর নির্ভরশীল এবং গ্যাস সরবরাহ কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে হয়।
কর্ণফুলি গ্যাসের তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহ এখন প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) হয়ে গেছে, যা বিভিন্ন সেক্টরের দৈনিক চাহিদা ৩১২-৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের তুলনায় অনেক কম। ৫ মে এই অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ ছিল মাত্র ২৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
ঘাটতি থাকায় গ্যাস নির্ভর খাতগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; বিশেষ করে ভারী শিল্প, সিমেন্ট কারখানা এবং তৈরি পোশাক শিল্প।
চট্টগ্রামে ৩ হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১,২০০টি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– স্টিল, সিমেন্ট, জাহাজ ভাঙা, ঢেউটিন এবং পোশাক খাত।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের দুটি সার কারখানার মধ্যে বর্তমানে শুধু কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) চালু আছে। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
গ্যাস সংকট শুধু শিল্প খাতেই নয়, প্রভাব ফেলেছে সাধারণ গ্রাহকদের উপরেও। কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চট্টগ্রামে ছয় লাখের বেশি গ্রাহক সংযোগ রয়েছে, যার মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগও রয়েছে। বর্তমানে এসব সংযোগে গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩১২ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে শিল্প খাতে প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন, গৃহস্থালি খাতে ৩৫ মিলিয়ন, কাফকোতে ৪৬ মিলিয়ন, সিইউএফএলে ৪৪ মিলিয়ন, রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪০ থেকে ৪২ মিলিয়ন এবং শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩২ থেকে ৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
শিল্প খাতের তুলনায় গৃহস্থালি খাতে গ্যাস সরবরাহ অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক কি না—এমন প্রশ্নে কর্ণফুলী গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বলেন, 'শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাসের আলাদা কোন লাইন নেই। আবাসিক এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই লাইনে গ্যাস সরবরাহ হয়। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাসের সংকট আছে বলে মনে হয় না।'
গ্যাসের চাপ কম, খরচ বাড়ছে—বিপর্যয়ে শিল্প খাত
দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে অভিযোগ করে আসছেন দেশের শিল্প মালিকরা।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গ্যাসের সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। উৎপাদন সচল রাখতে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে, ফলে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে হলে দ্রুত এই সংকটের সমাধান দরকার।
জিপিএইচ ইস্পাতের জেনারেল ম্যানেজার (প্রোডাকশন) রিমন বড়ুয়া বলেন, গ্যাসের চাপ কমে গেলে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়, এতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণে টেক্সটাইল কারখানায় রঙের মান খারাপ হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হলে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানা বেকায়দায় রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের জরুরি শিপমেন্ট রয়েছে, তারা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।'
এলএনজি আমদানি কমে যাওয়া ঘাটতির মূল কারণ
চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি নির্ভর করে এলএনজির ওপর। তাই কক্সবাজারের মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ কমলেই সংকট প্রকট হয়ে ওঠে—এমনটাই জানিয়েছেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তারা।
মহেশখালী উপকূলে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সম্মিলিত দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা প্রায় ১,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়া, রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা কারণে একাধিক সময়ে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ কমে আসে।
এলএনজি আমদানির কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে পেট্রোবাংলার অধীনস্থ রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। সংস্থাটির জেনারেল ম্যানেজার (এলএনজি) মো. শাহ আলম নিশ্চিত করেছেন, আমদানি কম হওয়ায় সক্ষমতার তুলনায় কম এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।
বর্তমানে বেসরকারি খাতে পরিচালিত দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ৫ মে এ সরবরাহ ছিল ৮৪০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গ্যাস সংকটে বন্ধ সিইউএফএল
গ্যাস সংকটের কারণে ১১ এপ্রিল থেকে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড-এর (সিইউএফএল) উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই কারখানাটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
সিইউএফএলের হেড অব অপারেশন উত্তম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, কারখানাটি আগে কর্ণফুলী গ্যাস থেকে দৈনিক ৪৪-৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেত এবং প্রতিদিন প্রায় ১,১৫০ টন সার উৎপাদন করত।
তিনি বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় এখন পুরোপুরি বন্ধ সার কারখানা। আমরা উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় আছি। কবে নাগাদ গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই।'