নগর পরিবহন ও গোলাপি বাস: হোঁচট খাচ্ছে ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ

ঢাকার কুখ্যাত বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ—নগর পরিবহন ও গোলাপি বাস সার্ভিস—মুখ থুবড়ে পড়ছে। চালু হওয়ার পর কয়েক মাস পরই পরিচালন-সংক্রান্ত নানা বাধার মুখে পড়েছে এ দুই উদ্যোগ।
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের আওতায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন করে সেবা চালু করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির উদ্যোগে ৬ ফেব্রুয়ারি পৃথকভাবে রাস্তায় নামানো হয় গোলাপি বাস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবার মান বৃদ্ধি এবং উন্নত যাত্রী অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও এ দুই উদ্যোগের কোনোটিই ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।
প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন করে চালু
অদক্ষতার কারণে আগে একবার চালু হয়েও বন্ধ হয়ে যাওয়া নগর পরিবহন সেবা ৩৫টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস নিয়ে রুট-২১-এ (গাবতলী-চাষাড়া) ফের চালু করা হয়।
সংস্কারকৃত বাস রুট রেশনালাইজেশন উদ্যোগের আওতায় ঘোষণা করা হয়েছিল, নির্ধারিত রুটের সমস্ত সব বাস অপারেটরকে নগর পরিবহনের ছাতার নিচে নিয়ে এসে অবৈধ বাসগুলো উঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
এসব রুটজুড়ে এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ বাস। এতে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে নগর পরিবহন। ফলে অপারেটরটি তাদের চালু থাকা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে, সেইসঙ্গে কমেছে সেবার মান।
যাত্রী সানওয়ার উল্লাহ বলেন, 'নগর পরিবহনের বাসগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় যাত্রা আরামদায়ক হলেও ৩০-৪০ মিনিটের অপেক্ষা অসহ্য।'
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, এই সেবার আওতায় এখন প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক বাসও চলছে না। যেখানে অন্তত ২০টি বাস দরকার, সেখানে চলছে মাত্র ৭-৮টি। দৈনিক ট্রিপও ১৫টির নিচে নেমে এসেছে।
একজন কাউন্টার কর্মী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, 'এভাবে যাত্রীরা এত লম্বা সময় [বাসের জন্য] অপেক্ষা করবে না। এটা টেকসই নয়।'
নগর পরিবহনের অপারেটর আজিজুল আনসারি অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে সেবা সীমিত করার স্বীকার করে বলেন, 'মাত্র এক মাসেই প্রায় ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছি। আমরা নির্ধারিত স্টপেজে থামলেও অবৈধ বাসগুলো যত্রতত্র যাত্রী তোলে। এই প্রতিযোগিতা অসম।'
তিনি আরও বলেন, টিকিট কাউন্টারের মতো অসম্পূর্ণ অবকাঠামো নিয়ে প্রকল্পটি তড়িঘড়ি করে শুরু হয়। তার ওপরে 'কাউন্টার বসানোর জন্য একটি মহল চাঁদাও দাবি করছে,' বলেন তিনি।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আক্তার সমস্যাগুলো স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা অননুমোদিত বাসগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি, তবে এতে সময় লাগবে। বাস কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনা চলছে। ধাপে ধাপে সব অপারেটরকে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে।'
চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, 'আমরা পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।'
নতুন রং, পুরনো সমস্যা
ঢাকার বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে চালু হওয়া গোলাপি বাস সেবাও চাপে রয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় ২১টি কোম্পানির ২ হাজার ৬০০-র বেশি বাস রয়েছে। এসব বাসে ওঠার আগে টিকিট কিনতে হয় এবং অনির্ধারিত স্টপেজে বাস থামানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
কিন্তু শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনার শিকার এই সেবা।
যাত্রীদের অভিযোগ, বাসগুলো এখনও যত্রতত্র রাস্তার মাঝখানে থামে। এছাড়া কাউন্টারের সংখ্যা অপ্রতুল এবং সেবার মানও প্রথাগত বাসের মতোই রয়ে গেছে, কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেন।
যাত্রী মেহেদী হাসান হাসিব বলেন, 'একমাত্র পার্থক্য হলো রং। বাসের সিট এখনও ভাঙা, ভাড়াও নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে ৫-১০ টাকা বেশি নিচ্ছে।'
বাড্ডার যাত্রী আনোয়ার শামীম বলেন, 'বেশিরভাগ স্টপেজে টিকিট কাউন্টারই নেই। বাসগুলো চলছে যেকোনো লোকাল সার্ভিসের মতোই।'
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এস এম আহমেদ খোকন দায় চাপালেন কাউন্টারের জন্য জায়গার অভাব, বিআরটিসি ও স্থানীয় বাসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা আর পরিবহন শ্রমিকদের বিরোধিতার ওপর। শৃঙ্খলাভিত্তিক মডেলের কারণে শ্রমিকদের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খোকন বলেন, 'বাধা সত্ত্বেও আমরা একে কার্যকর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিয়মকানুন কার্যকরভাবে পুনর্মূল্যায়ন এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগের জন্য শিগগিরই একটি সভা হবে।'
নগর পরিবহন ও গোলাপি বাস সেবা উভয়ই ঢাকার রাস্তায় বিদ্যমান চুক্তিভিত্তিক বিশৃঙ্খল বাস চলাচল বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু প্রয়োগের দুর্বলতা, স্বার্থান্বেষী মহলের বাধা ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির কারণে এ প্রচেষ্টাগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।