ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সম্প্রসারণে ধীরগতি: যাত্রী-চালকদের দুর্ভোগ চরমে

সিলেটের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ঢাকায় চাকরি করেন। ঈদের ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাসে ওঠেন ঢাকায় যেতে। ঢাকা যেতে সাধারণত সময় লাগে ৬ ঘণ্টা; কিন্তু তার লাগল প্রায় ১৪ ঘণ্টা।
সাইফুল বলেন, 'সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। তাই সড়কের অনেকটা জুড়ে মাটি, বালু, পাথরসহ বিভিন্ন সামগ্রী পড়ে আছে। বৃষ্টির কারণে মাটি ছড়িয়ে পুরো সড়ক কাদাময় হয়ে পড়ে। এতে দুর্ঘটনা এড়াতে যানবহানের গতি কমিয়ে আনতে হয়।'
সড়ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নেওয়া দুটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পের ধীরগতির কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলকারী প্রায় সব যাত্রীকেই এরকম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকা-সিলেট-তামাবিল মহাসড়ককে ছয় লেনে এবং ৫০.৫৮ কিলোমিটার আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে।
কিন্তু এই দুই প্রকল্পের কাজই চলছে একেবারে ধীরগতিতে। এতে এ সড়কে সবসময়ই লেগে থাকে যানজট। ভ্রমণে সময় লাগছে বেশি, আর রাস্তার অবস্থা আরও বেহাল হচ্ছে।
সাইফুল বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢোকার পর থেকেই দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়। এই যানজট একেবারে ঢাকা পর্যন্ত ছিল।
'ফলে পাঁচ মিনিট গাড়ি চলে তো আধাঘণ্টা থেমে থাকে—এভাবেই আসতে হয়েছে,' বলেন তিনি।
অন্যান্য যাত্রীরাও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি যানজট হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিশ্বরোড থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত অংশে।
ঈদের মতো ছুটির সময়ে সড়কে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বাড়লে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। তখন ৫-৬ ঘণ্টার পথ পেরোতে ১৬-১৭ ঘণ্টাও লেগে যায়।
চলমান দুটি বড় প্রকল্পে বিলম্ব
৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-সিলেট-তামাবিল মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
একইসঙ্গে আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে।
দুটি প্রকল্পের কাজই চলছে ধীরগতিতে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল চার লেন প্রকল্পের কাজ।

বড় প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় এই সড়কে এখন জরুরি সংস্কার কাজও বন্ধ রয়েছে। ফলে ভাঙাচোরা সড়ক দিয়েই যান চলাচল করছে। ফলে যানজট পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে নিরাপত্তা উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ছয় লেন প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
এ প্রকল্পের সিলেট অংশের প্রজেক্ট ম্যানেজার দেবাশীষ রায় বলেন, 'আমাদের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ছিল। এ কারণে কাজ আশানুরূপ এগোয়নি। তবে এখন জটিলতা অনেকটা কেটে গেছে। এখন দ্রুত গতিতেই কাজ এগিয়ে চলবে।'
এই প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ২০৯ কিলোমিটার সড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ এবং সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের ৫৬.১৬ কিলোমিটার অংশ চার লেনে উন্নীতকরণ করার কথা রয়েছে।
আগামী বছরের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার সম্ভাবনা কম।
গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল আশুগঞ্জ-আখাউড়া ৫১ কিলামিটার সড়কের চার লেন প্রকল্পের কাজ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পে নিয়োজিত ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ দেশে চলে যাওয়ায় বন্ধ ছিল নির্মাণকাজ। ফলে এ প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। তবে নভেম্বর থেকে আবার এই সড়কের কাজ শুরু হয়েছে।
চার লেন প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. শামীম আহমেদ বলেন, 'এখন পুরোদমে কাজ এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে পুরো কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়ানো হতে পারে।'
এই সড়কে বাস চালানো একাধিক চালক বলেন, এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় খানাখন্দের কারণে যান চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বরোড মোড়ে প্রায় প্রতিদিনই তীব্র যানজট লেগে থাকে।
তারা বলেন, মহাসড়কের আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ১২.২১ কিলোমিটার অংশজুড়ে আছে খানাখন্দ ও ছোট-বড় গর্ত। সে কারণে এখানে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ নেমে আসে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারে। এই অংশে সবসময় দীর্ঘ জানজট লেগে থাকে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, দীর্ঘদিন প্রকল্পের অধীনে থাকায় মহাসড়কটিতে নিয়মিত সংস্কার কাজ হয়নি। ফলে মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তত ৪ কিলোমিটার অংশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছার নিশ্চয়তা নেই
সিলেট থেকে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করতে হয় ব্যবসায়ী ফয়সল আলমকে। তিনি বলেন, সবসময় ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক সময় বাসে চলাচল করতে হয়। কিন্তু এই সড়কে বাসে করে যাতায়াতে দুর্ভোগের শেষ নেই।
'বাসে ওঠার পর কখন গিয়ে ঢাকায় পৌঁছাব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। সড়ক ভাঙার কারণে ঝাঁকুনি তো আছেই,' বলেন তিনি।
ফয়সাল আরও বলেন, 'প্রায় দুই বছর ধরে ছয় লেনের কাজ চলছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এখনও ভূমি অধিগ্রহণই শেষ হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে ১০ বছরেও কাজ শেষ হবে না।'
তিনি বলেন, সড়কের এই দুরবস্থার সুযোগে সিলেট-ঢাকা রুটে বিমান ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-সিলেট সড়কে চলাচলকারী মিতালী বাসের চালক গউছ উদ্দিন বলেন, 'সড়কের এমন বেহাল অবস্থা যে আমরা যাত্রীদের কেবল যাত্রার সময় বলি। পৌঁছার সময়ের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেই না।
'আগে ঢাকা-সিলেট একদিনে যাওয়া-আসা করতে পারতাম। এখন কেবল যেতেই একদিন লেগে যায়। ভাঙাচোড়া সড়ক, চলমান উন্নয়ন কাজ ও বিভিন্ন স্থানে সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা দোকানপাটের কারণে সবসময় যানজট লেগেই থাকে।'
সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সিলেট অংশের কিছুটা ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে একপাশ বন্ধ রেখে সম্প্রসারণ কাজ চলছে।
বেশ কয়েকটি স্থানে চলছে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ। অনেক জায়গায় মাটি ভরাট ও জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। নির্মাণকাজের কারণে সড়ক সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে যানজট। এছাড়া সড়কের অনেক জায়গায় খানাখন্দেরও সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে বেড়েছে ভোগান্তি। বিভিন্ন স্থানে সড়ক দেবে গেছে, কোথাও তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। আবার কোথাও পিচ সরে গিয়ে নিচের পাথর বের হয়ে এসেছে।
এসব কারণে যানবাহনের গতি কমে আসায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনাও।
ছয় লেনের কাজ চলমান থাকায় এখন ভাঙাচোড়া অংশও সংস্কার করছে না সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
তবে সড়ক ও জনপথ অধিপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মূল সড়কে এখন উন্নয়ন কাজ হচ্ছে না। সড়কের পাশে কাজ করা হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, 'মহাসড়কটি নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে। দুই লেনের মহাসড়কটি ছয় লেন হচ্ছে। তাই পুরনো সড়কে খুব বেশি ব্যয় করা হচ্ছে না। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন কেবল ততটুকু করা হচ্ছে।'
তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত সড়কের বেহাল দশা এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে যাতায়াত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সিলেট অঞ্চলের কোটি মানুষকে।