৩ সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতিতে সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না: প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার পর পৃথক তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের তিনজন সাংবাদিককে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুতি এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ প্রচার সাময়িক বন্ধ ঘোষণার ঘটনায় সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে অনেকে পরোক্ষভাবে চ্যানেলগুলোর অন্যায় চাকুরিচ্যুতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।'
আজ শুক্রবার (২ মে) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জুলাই বিপ্লব স্মৃতি হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত 'জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক আলোচনা সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, 'সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আপনারা দেখেছেন তিনটি পৃথক টেলিভিশন চ্যানেলের তিনজন সাংবাদিক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। একটি চ্যানেল অল্প কিছু সময়ের জন্য তাদের সংবাদ প্রচার বন্ধ রেখেছে। যদিও কোনো চ্যানেলেই এসবের আনুষ্ঠানিক কোনো কারণ জানায়নি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এ ঘটনায় সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি এই ঘটনায় সরকারকে দায়ী করা অনভিপ্রেত। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ চ্যানেলেগুলোকে তাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেনি। তবুও সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে অনেকে পরোক্ষভাবে চ্যানেলগুলোর অন্যায় চাকুরিচ্যুতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকারের পক্ষে এই চাকুরিচ্যুতিকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না, কেন না চ্যানেলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাধীনভাবে।'
তিনি বলেন, 'দুর্নীতি, অন্যায় ও অপশাসন প্রতিরোধে জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই মানুষের এই অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। তবে সরকার সবসময় আশা করে গণমাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।'
আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'মুক্ত গণমাধ্যমের ব্যাপারে সরকারের উদার নীতির সুযোগ নিয়ে মূলধারার অনেক গণমাধ্যমকেও সাম্প্রতিক সময়ে অপপ্রচারে লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। ফ্যাক্ট-চ্যাকিংয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের অনেক সংবাদ চিহ্নিত করেছেন, যা জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে খর্ব করে। ডিজিটাল মাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ও গুজবের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সরকার গুজব প্রতিরোধে অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে কিছুটা সাফল্যও এসেছে। তবে গুজবের বিপক্ষে লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা অনেক বড়।'
সরকারের একার পক্ষে এ ধরনের লড়াই কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অপতথ্য প্রতিরোধে সরকার যে উপায়টি সর্বপ্রথম বেছে নিয়েছে, তা হচ্ছে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি যত বেশি সাংবাদিকের কাছে আমাদের তথ্যগুলো দেওয়া যায়। আমাদের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনগুলো সব সাংবাদিকের জন্য উন্মুক্ত রেখেছি। অনেক সময় সাধারণ মানুষ এসেও এসব সংবাদ সম্মেলনে আমাদের প্রশ্ন করেছেন। অন্য সবার মতো আমরাও বিশ্বাস করি, প্রশ্ন করা সাংবাদিকদের অধিকার। এ কারণে প্রিয়-অপ্রিয় সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত থেকেছি।'
উপ-প্রেস সচিব বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার পর কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে আবির্ভূত হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার এই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে আর কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা এই আইনে করা হয়নি।'
তিনি বলেন, 'আমরা আশা করছি আগামী সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে, আগের আইনের নিবর্তনমূলক ৯টি ধারা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের আইনের আওতায় করা ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায় করা। ধারাগুলো বাতিল হলে এসব ধারায় করা কোনো মামলা থেকে গেলেও তা সয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাবে।'
প্রস্তাবিত নতুন আইনে গুরুতর সাইবার হ্যাকিং ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিধান বাতিল করা হচ্ছে উল্লেখ করে আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'অন্তবর্তীকালীন সরকার বিশ্বাস করে, নতুন এই আইন প্রণয়ন করা হলে দেশে সাংবাদিকদের আইনের মাধ্যমে হয়রানি অনেকটাই কমে আসবে। দেশে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি হবে একটি বড় অগ্রগতি।'
তিনি আরও বলেন, 'গত আট মাসে অনেক সাংবাদিককে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে জুলাই-আগস্টের সময়ে তাদের ভূমিকার কারণে। কিন্তু আপনারা জেনে থাকবেন, এসব মামলা একটিও সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ দায়ের করেনি। সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে পরিষ্কার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তদন্তকালে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়া গেলে কোনো সাংবাদিককে যেন গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করা হয়।'
উপ-প্রেস সচিব বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬৮ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। যদিও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল এবং ইস্যু একটি নিয়মিত বিষয়। সাংবাদিকদের জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রথা চালু করার পর ৭ হাজার ৮৬৬টি অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বাতিল হয়ে গেছে ৪ হাজার ৯৩৫টি কার্ড। তবু এই বিষয়টিতে সরকারের সমালোচনা হওয়ায় সরকার এটি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'যাদের কার্ড বাতিল হয়েছে তাদের আবার আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মাত্র সাত জন আপিলের মাধ্যমে তাদের কার্ড ফেরত চেয়েছেন। সচিবালয়ে অগ্নি দুর্ঘটনার পর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ব্যবহার করে সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার সীমিত করা হলে, সাংবাদিকদের বিশেষ পাশ ইস্যু করে সেখানে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রায় ৫৭০জন সাংবাদিকের জন্য এ ধরনের পাশ ইস্যু করা হয়েছে। অতীতে অনেক দলীয় কর্মীদেরও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে সচিবালয়ে সাংবাদিক নামধারী কিছু দালালের দৌরাত্ম্যে পেশাদার সাংবাদিকদের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সরকার নতুন করে সবার জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'