শুধু সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে একমত সব দল, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভক্ত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সময় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র বিভেদ দেখা গেছে। পরিস্থিতি বলছে, দেশের রাজনীতিতে সাধারণ ঐকমত্য খুঁজে বের করা কমিশনের পক্ষে কঠিনই হবে।
সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনে সম্মত হলেও প্রধানমন্ত্রীর দুই মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, সংবিধানের মূলনীতি, ভোটদানের পদ্ধতি, সংসদের মেয়াদ, ভোটার ও প্রার্থীর বয়সসহ অন্যান্য প্রধান বিষয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো।
জামায়াত ও এনসিপি চায় কোনো ব্যক্তি জীবনে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অন্যদিকে বিএনপির বক্তব্য, কোনো ব্যক্তি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; তবে একবার বিরতি নিয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, 'একজন প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদে ১০ বছর থাকতে পারবেন, কিন্তু এরপর আর কন্টিনিউ করতে পারবেন না।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশিও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, যদি দুই মেয়াদের মাঝে একটি বিরতি থাকে।
আবার জামায়াতে ইসলামী চাচ্ছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন, কিন্তু বিএনপি চাইছে বিদ্যমান পদ্ধতিতে। অন্যদিকে এনসিসি গঠনে বিএনপির সায় নেই, কিন্তু জামায়াত ও এনসিপি এনসিসি গঠনে সমর্থন দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হনই। গতকাল তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এখনও আলোচনা চলমান রয়েছে, সেহেতু এ ব্যাপারে ডেফিনিটিভ কোনো মন্তব্য ভুল বোঝাবুঝি কিংবা বিভ্রান্তি তৈরি করবে।'
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে সবাই একমত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এ পর্যন্ত ১৭টি রাজনৈতিক দলের আলোচনা হয়েছে। আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ১৪টি দল।
উচ্চকক্ষের বিষয়ে কমিশন ও দলগুলোর সম্মতি থাকলেও এর নাম, গঠন, মেয়াদ ও দায়িত্ব-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এখনও অমীমাংসিত। এসব বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রেখেছে।
উচ্চকক্ষের নাম বিএনপি ও সংস্কার কমিশন 'সিনেট' হিসেবে সুপারিশ করেছে। জামায়াত কোনো নাম উল্লেখ করেনি। আর এনসিপি উচ্চকক্ষের নাম 'জাতীয় পরিষদ' প্রস্তাব করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, উচ্চকক্ষে আসন সংখ্যা ১০০ রাখা যেতে পারে; যদিও কমিশন ১০৫টি আসন রাখার প্রস্তাব করেছে।
'উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবেন, আনুপাতিক হারে আসবেন কি না—সে বিষয়ে আমরা বলেছি, আগে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক। দ্বিকক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে এ বিষয়ে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।'
এদিকে জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, 'দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। তবে এটার আকার, আকৃতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আলোচনা করছি।'
উচ্চকক্ষের বিষয়ে দলগুলোর সুপারিশ কী
এনপির দেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, সংসদের উচ্চকক্ষে অন্তত ৫০টি আসন থাকবে। সংরক্ষিত মহিলা-সদস্যদের নির্বাচনে বর্তমান যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেই পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। দলটি সুপারিশ করেছে, নিম্নকক্ষে পাশ হওয়া বিল সুপারিশ/পুনর্বিবেচনার জন্য উচ্চকক্ষে পাঠানো হবে। উচ্চকক্ষ এরকম বিল সুপরিশসহ অথবা সুপারিশ ছাড়াই পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারবে। বিএনপি আরও সুপারিশ করেছে, একজন ব্যক্তি উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে কেবল এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ১৫১ আসনবিশিষ্ট উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছে, যেখানে সদস্য থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, শীর্ষ আদালতের বিচারক-কর্মকর্তা, আমলা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দলটির প্রস্তাবে।
এনসিপি প্রস্তাব করেছে, উচ্চকক্ষ রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকবে। উচ্চকক্ষ পরপর তিনবার কোনো আইন পাশ না করলে তা গণভোটে যাবে। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ উভয়ের মেয়াদ হবে চার বছর। উচ্চকক্ষের ১০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৩৩টি আসনে পেশাজীবী-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-সাংবাদিকসহ আইনদ্বারা তফসিলভুক্ত পেশা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে মনোনয়ন দিতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সুপারিশ করেছে, উচ্চ কক্ষের সদস্য হবে ১৫০। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করার সুপারিশও করেছে তারা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) প্রস্তাব করেছে, উচ্চকক্ষ হবে ২০০ সদস্যবিশিষ্ট।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, উচ্চকক্ষের আসন হবে ১০৫টি এবং মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের সমান, অর্থাৎ চার বছর। নিম্নকক্ষ ভেঙ্গে দেওয়া হলে উচ্চকক্ষও ভেঙে যাবে।
রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের জন্য ১০০ জন প্রার্থী মনোনীত করবে। উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করার ক্ষমতা থাকবে না। তবে নিম্নকক্ষে পাশ হওয়া অর্থবিল ছাড়া সমস্ত বিল উভয় কক্ষে উপস্থাপিত হতে হবে।
নিম্নকক্ষের বিল উচ্চকক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে, কিন্তু কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকাতে পারবে না। কোনো বিল দুই মাসের বেশি আটকে রাখা হলে তা উচ্চকক্ষ দ্বারা অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল চায় জামায়াত ও এনসিপি, বিএনপির না
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি উভয় দলই জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে একমত হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
জামায়াতে নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, 'ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। আরও বিস্তারিত আলোচনা দরকার। এটি গঠনের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে কমিটিতে না রাখতে বলেছি।'
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'সাংবিধানিক কাউন্সিল সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিয়োগ দেবে।'
অন্যদিকে বিএনপির সালাউহদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য জাতীয় সংবিধান পরিষদ গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই।'
সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে মতবিরোধ
সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের যে ধারাগুলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক নীতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে, সেগুলোকে ১৫তম সংশোধনীর আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা উচিত।
'১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে সমানভাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না,' বলেন তিনি।
এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, 'সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ভূমিকা (প্রস্তাবনা)। কমিশন এটিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে, যা আমরা উপযুক্ত মনে করি না।'
অন্যদিকে এনসিপি বলেছে, সংবিধানে মূলনীতি রাখারই প্রয়োজন নেই।
নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'সংবিধানের মূলনীতির বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব ছিল, মূলনীতিগুলো বাতিল করা। আমরা চার মূলনীতি বাতিলের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছি এবং বহুত্ববাদের বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞায়ন চেয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'বাহাত্তরের মূলনীতি ও পরবর্তী সংশোধনীর মাধ্যমে যে দলীয় মূলনীতিগুলো প্রবেশ করানো হয়েছে, সেগুলো বাতিলের দাবি জানিয়েছি আমরা।'
জামায়াতের সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, 'বহুত্ববাদকে পুরো বাদ দিতে হবে। আমরা প্রস্তাব করেছি সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য।'
ভোটের পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য
আনুপাতিক হার (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন জানিয়ে জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এটা হলে নির্বাচনে দুর্নীতি, জবরদখল, ভোটবিহীন নির্বাচন ও টাকার খেলা বন্ধ হবে। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে বিএনপি বিদ্যমান পদ্ধতিকেই সমর্থন দিচ্ছে। এ বিষয়ে এনসিপি এখনও কোনো স্পষ্ট অবস্থান জানায়নি।
সংসদের মেয়াদ
এনসিপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে ৪ বছর, যা সংবিধান সংস্কার কমিশনও সুপারিশ করেছে। তবে এ বিষয়ে বিরোধিতা করেছে বিএনপি ও জামায়াত। তারা বলেছে, ৫ বছর করেই হবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ।