এনবিআরের শুদ্ধি অভিযানে ৯ মাসে চাকরিচ্যুত ১১ কর্মকর্তা

দুর্নীতি, অনিয়ম ও পেশাগত অসদাচরণের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের প্রশাসনের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ অভিযানে গত ৯ মাসে কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের অন্তত ১১ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন দুজন। এছাড়া, নিচের স্তরের আরও পাঁচজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চলতি এপ্রিল মাসেই মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত বুধবার দুই কমিশনারকে অবসরে পাঠানো হয়েছে, যাদের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের জামাতা।
এনবিআর সূত্র জানায়, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত আরও অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এই তদন্তে এনবিআরের আওতাধীন ইনকাম ট্যাক্স ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ছাড়াও অন্যান্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাও যুক্ত রয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি একাধিক আলোচনায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আপনারা ইতিমধ্যে কিছুটা টের পেয়েছেন। ভবিষ্যতেও সেটি দেখতে পাবেন।'
আরেক আলোচনায় তিনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিষয়ে প্রমাণসহ অভিযোগ দেওয়ারও আহ্বান জানান।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এনবিআরের এই পদক্ষেপকে 'শুদ্ধি অভিযান' হিসেবে অভিহিত করেছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'এটি বর্তমান এনবিআরের কাছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত বিষয়। এখন এনবিআরের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, চাপও আছে—সে কাজটি করছে। এটিকে সাধুবাদ জানানো উচিত।'
তিনি বলেন, 'এনবিআর এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যারা সততার সঙ্গে কর দিতে চায়, তাদের জন্য হেল (নরক), আর যারা কর ফাঁকিবাজ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী আর অর্থপচারের সাথে জড়িত—তাদের জন্য হেভেন (স্বর্গ)।'
'এনবিআরের কর্মকর্তাদের একাংশ কর ফাঁকিতে সাহায্যকারীর ভুমিকা পালন করেন', যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এরকম হাতেগোনা কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, অন্য অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এনবিআরের আয়কর বিভাগের এক সাবেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, '৯ মাসে এক ডজনেরও বেশি ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা আমরা আগে কখনও দেখিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি সত্যিই একটি শুদ্ধি অভিযান মনে হচ্ছে।'
সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমানতুল মুনিমের সময়ে ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ নাইরুজ্জামান বলেন, 'আমাদের সময় এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। কেবল অল্প কিছু ছোটখাটো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।'
চাকরি হারিয়েছেন যারা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনাল রিসোর্স ডিভিশনের দুই পৃথক গেজেটে জানানো হয়, গত ২৩ এপ্রিল মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান ও মো. শফিকুল ইসলাম আকন্দকে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
১৭ এপ্রিল এনবিআরের সদস্য আবু সাঈদ মোস্তাক ও ট্যাক্স কমিশনার গোলাম কবীরকেও অবসরে পাঠানো হয়।
সরকারি চাকরি বিধিমালার ৪৫ ধারার আওতায় ২৫ বছর চাকরিজীবন পার করা কর্মকর্তাদের সরকার 'জনস্বার্থে' ব্যাখ্যা ছাড়াই অবসরে পাঠাতে পারে। এই ধারাতেই চার কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
আবু সাঈদ মোস্তাক ও গোলাম কবীরের বিরুদ্ধে ঢাকার ট্যাক্স জোন-৫ এ কর্মরত অবস্থায় আলোচিত প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম ফারুকি হাসানের শত কোটি টাকার রেমিট্যান্সকে অবৈধভাবে করমুক্ত দেখানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ১৭ অক্টোবর বরখাস্ত হয়েছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার সাইফুল আলম, যুগ্ম কমিশনার একেএম শামসুজ্জামান এবং সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলাম। তবে বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার পর, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পুনর্বহাল করা হয়েছে।
২২ আগস্ট কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হককে দুর্নীতির অভিযোগে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। দুদকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
আয়কর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার শাহ মোহাম্মদ মারুফ 'দুর্নীতির প্রবণতা' থাকার অভিযোগে চাকরি হারান।
আবার, কাস্টমসের উপকমিশনার মৌসুমী সরকার ও ফাহমিদা মাহজাবিন নিজেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান—তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না।
যুগ্ম কমিশনার ফখরুল আমিন চৌধুরীকেও সরকারি চাকরিবিধির ৩(খ) ধারা অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ভ্যাট কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান ও যুগ্ম কমিশনার লুৎফুল কবীরকেও বরখাস্ত করা হয়। তবে শুল্ক কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাপের কারণেই মাহবুবুর রহমান বরখাস্ত হয়েছেন—কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটি মন্তব্যকে ঘিরে প্রশ্ন উঠেছিল।
নিচের স্তরের কিছু রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আতঙ্কে সৎ কর্মকর্তারাও
দুর্নীতির অভিযোগে শুদ্ধি অভিযান জোরদার হওয়ায় এনবিআরের মাঠপর্যায়ে এখন চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতিবাজদের পাশাপাশি এখন অপেক্ষাকৃত সৎ ও নিরীহ কর্মকর্তারাও নানা অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছেন। এসব অভিযোগ দুদক, এনবিআর বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে দায়ের করা হচ্ছে—ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল বা বেআইনি সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে।
তারা জানান, কিছু ব্যক্তি নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কিংবা অখ্যাত কিছু গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দাবি করে রিপোর্ট প্রকাশের হুমকি দিয়ে বেআইনি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে।
এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা শঙ্কা বাড়ায় অনেক কর্মকর্তা এখন বড় পরিসরের মাঠ পর্যায়ের অভিযান থেকে সরে আসছেন। ফলে এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের অভিযান কার্যক্রমে ধীরগতির স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে।
একজন এনবিআর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুধু দুর্নীতিগ্রস্তদের নয়, সৎ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। অনেকে গণমাধ্যমে ভিত্তিহীন প্রতিবেদন প্রকাশ করে চাপ সৃষ্টি করছে, এতে নিরীহ কর্মকর্তারাও আতঙ্কে পড়ছেন।'
এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, নিরপরাধ কর্মকর্তারা যাতে ক্ষতির শিকার না হন, সেজন্য সব অভিযোগ যাচাই করে, সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে গোটা বিভাগে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে।