নিম্নমানের কয়লা আমদানি: মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নেয়া হবে নতুন সরবরাহকারী, নতুন দরপত্রের প্রস্তুতি

বাংলাদেশের মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্লোবাল ট্রেডিং (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেডের কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা চালানে নিম্নমানের কয়লা পাওয়ার পর মাতারবাড়ী ১,২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নতুন কয়লা সরবরাহকারী নিতে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এজন্য কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও বিদ্যুৎ বিভাগের সদস্যদের নিয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিম্নমানের কয়লা সরবরাহের অভিযোগ ওঠা সরবরাহকারীর বক্তব্য শোনার পাশাপাশি নতুন কয়লা সরবরাহকারীর জন্য দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিটকে।
এ কমিটি ভবিষ্যতের সরবরাহের পাশাপাশি ইতিমধ্যে বর্তমান সরবরাহকারীর সরবরাহ করা কয়লার বিষয়টিও খতিয়ে দেখবে।
গত ১৭ মার্চ মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহকারীর আমদানি করা কয়লার ১১তম চালানে বিপুল পরিমাণে মাটি পাওয়ার পর চালানটি ফিরিয়ে দেয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। এ ঘটনার পরই সরবরাহকারী বদলাতে নতুন দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
এই কনসোর্টিয়ামটি ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে আদিত্য বিড়লার মালিকানাধীন ইন্দোনেশিয়ার একটি খনি থেকে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করে আসছে।
কোল পাওয়ার জেনারেশন সরবরাহকারীদের কাছে কয়লার মান নিয়ে এক ডজনেরও বেশি বার প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, নিম্নমানের কয়লা ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নানা পরিচালন জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কাবির খান বলেন, 'মাতারবাড়ীর কয়লা সরবরাহকারীর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি জয়েন্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরবরাহকারীর বক্তব্য শোনার পর আমরা এই সরবরাহকারীর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। আর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নতুন কয়লা সরবরাহকারী নিতে নতুন দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।'
এর আগে বিদ্যুৎ বিভাগ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তিনটি সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে একটি সুপারিশ হচ্ছে কয়লা খালাসের স্থানে কয়লার মান পরীক্ষা করা, যা সরবরাহ চুক্তিতে উল্লেখ ছিল না। বাকি দুটি সুপারিশ হচ্ছে, সরবরাহকারী চুক্তিতে উল্লেখিত খনি থেকেই কয়লা দিচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হতে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা খনি পরিদর্শন করা, এবং পূর্বে সরবরাহ করা কয়লার মান পরীক্ষা করা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ এর আগে টিবিএসকে বলেছিলেন, 'কয়লার মান নিশ্চিত করতে আমরা কিছু নতুন ব্যবস্থা নিয়েছি, যা চুক্তিতে ছিল না। আমরা এখন টেস্ট রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি; প্রতিবেদন এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হক বলেন, 'আমরা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বহুবার নিম্নমানের কয়লা সরবরাহের বিষয়টি তুলেছি, কিন্তু সরবরাহকারীরা কর্ণপাত করছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'নিম্নমানের কয়লার কারণে যদি সরবরাহ ব্যাহত হয়, তাহলে পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুষ্ঠু পরিচালনাই হুমকিতে পড়বে—কারণ আমাদের সরবরাহকারী একটাই।'
কয়লা ক্রয়ের দরপত্রের নথি অনুসারে, কয়লার গ্রস ক্যালরিফিক ভ্যালু হওয়া উচিত কেজিতে ৪ হাজার ৪০০ থেকে ৫ হাজার কিলোক্যালরি। ক্যালরিফিক ভ্যালু যত বেশি হয়, কয়লার কার্যকারিতাও তত বেশি হয়। সেই হিসাবে, মাতারবাড়ীর কয়লার ক্যালরিফিক ভ্যালু মাঝারি মানের।
দরপত্রে কয়লার আরও কিছু মানদণ্ড উল্লেখ আছে—ছাইয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ, সালফার ০.৮ শতাংশ, কার্বন ৩৮ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ, আর্দ্রতা ৩০ শতাংশ এবং কয়লার আকার হতে হবে ৫ মিমি থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিমি।
সরবরাহকারী কয়লার এসব মানদণ্ড পূরণ করছে না—এই অভিযোগে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি প্রথম দশটি চালানের প্রতিটির ১০ শতাংশ পেমেন্ট আটকে রেখেছে।
সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (প্রকিউরমেন্ট) দীপায়ন পাল টিবিএসকে বলেন, 'কয়লার মান নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে, তাই আগের ১০টি চালানের ১০ শতাংশ করে পেমেন্ট আটকে রেখেছি।'
১১তম চালানে সরবরাহকৃত কয়লায় অতিরিক্ত পরিমাণে বহিরাগত বস্তু মিশ্রিত থাকায় চালানটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরবরাহকারীর দাবি, সেই চালানের কয়লার ক্যালরিফিক ভ্যালু ছিল ৪ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি।
কিন্তু সেই কয়লা মাটি, পাথর, লালচে কণা ও অতিরিক্ত পানি মিশ্রিত ছিল। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়লা খালাস করতে পারেনি; কারণ চালানে অতিরিক্ত মাটিসহ অন্যান্য উপাদান থাকায় কয়লা খালাসের জন্য ব্যবহৃত কনভেয়র বেল্ট বারবার বিকল হয়ে যাচ্ছিল।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, 'সরবরাহকারী কয়লার ক্যালরিফিক ভ্যালু ৪ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি হওয়ার যে দাবি করেছে, তা হাস্যকর। আমরা এখন ল্যাব রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।'
এই বিষয়ে আদিত্য বিড়লা গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের সেলস ও মার্কেটিং স্পেশালিস্ট তারুণ মারুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, 'এই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।'
২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে পরের ১২ মাসে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩৫ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে গত বছর কনসোর্টিয়ামটির সঙ্গে চুক্তি করে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।
কনসোর্টিয়ামটি এখন পর্যন্ত ৬.৫০ লাখ টন কয়লা সরবরাহ করেছে।
নিম্নমানের কয়লা নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কোল পাওয়ার জেনারেশন ও এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ছাই, আর্দ্রতা ও সালফারের পরিমাণ বেশি, এমন কয়লা ব্যবহার করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৃহত্তর স্বার্থে এই নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার বন্ধ করা করা উচিত।
'এই কয়লায় কী ধরনের বহিরাগত উপাদান রয়েছে, তা আমরা জানি না। আর পরীক্ষা না করে এমন কয়লা ব্যবহার করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে দূষিত কয়লার কারণে বয়লার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'ভবিষ্যৎ ক্ষতির হাত থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বাঁচাতে কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাতারবাড়ী কর্তৃপক্ষের কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করা উচিত।'