‘ও বলেছিল আবার আমাকে ফোন করবে’: ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত আকরামের মায়ের আর্তনাদ

গত ১৩ এপ্রিল মায়ের সঙ্গে মোবাইলফোনে আকরামের শেষ কথোপকথন- 'আইচ্ছা আম্মা ভালো থাইকো, পরে আবার ফোন দিমুনে। আছি ভালোই, কিন্তু যেখানে কাজ করি, একটু আতংকের মধ্যে থাকন লাগে। ড্রোন আসে তো, এগুলা দেখে চলাফেরা করন লাগে।'
এরপর টানা পাঁচদিন ধরে সন্তানের ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন মা মবিনা বেগম। কিন্তু, ছেলের ফোন আর আসে না। তাই মায়ের অপেক্ষার প্রহরও শেষ হয় না। গতকাল শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) শেষ বিকেলে খবর আসে আকরাম আর নেই, প্রাণ হারিয়েছেন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এরপর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সন্তান শোকে কাতর মবিনা বেগম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের মোরশেদ মিয়া ও মবিনা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আকরাম মিয়া (২২)। মোরশেদ মিয়া পেশায় একজন কৃষক। আর কৃষক বাবার পক্ষে একা সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবার কষ্ট দূর করতে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আমতলা এলাকায় অবস্থিত 'এম. সোলাইমান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার' নামে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখে— গত ৯ মাস আগে পাড়ি জমান রাশিয়ায়। এজন্য দেনাও করেছিলেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। সেখানে গিয়ে একটি চীনা কোম্পানিতে কাজ পান। এরপর সংসারে আসতে শুরু করে স্বচ্ছলতা। তবে আকরামের পরিবারের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
পরিবারের অভিযোগ, মাত্র চার মাস কাজ করার পর বেতন বন্ধ করে দেয় চীনা প্রতিষ্ঠানটি। এরপর বেশ কিছুদিন বিনা বেতনে কাজ করিয়ে— আকরামকে বিক্রি করে দেয় রুশ বাহিনীর কাছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে নামেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। প্রথম প্রথম কষ্টের কথা জানালেও – পরে পরিবারের সবার কষ্টের কথা ভেবে আকরাম মেনে নেন যুদ্ধজীবন। প্রায় আড়াই মাস রণাঙ্গনে কাটানোর পর গত ১৪ এপ্রিল প্রাণ হারান আকরাম।

আজ শনিবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিন আকরামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আকরামের মৃত্যুর খবর পেয়ে এক এক করে আসছেন স্বজনরা। ছোট্ট একতলা বাড়িটিতে ভিড় লেগে আছে আত্মীয়-স্বজনদের। ঘরের বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছেন মা মবিনা বেগম। একটু পর পর উঠে আদরের সন্তানের কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন।
আর বাড়ির বাইরে বসে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা মোরশেদ মিয়া। একদিকে সন্তানের মৃত্যুশোক, অন্যদিকে সন্তানকে বিদেশ পাঠাতে করা ব্যাংক ও এনজিওর দেনা পরিশোধ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।
আকরামের মা মবিনা বেগম বলেন, গত ১৩ এপ্রিল আমাকে বলেছিল ভয়ের কথা। বলেছিল ঘুম থেকে উঠে সময় করে আবার ফোন দেবে। কিন্তু, ফোন আর দেয়নি। গতকাল ময়মনসিংহের এক ছেলে ফোন করে বলেছে আকরাম আর নেই। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের হামলায় মারা গেছে। 'আমার বিশ্বাস হয় না– আমার ছেলে নাই, মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ফোন দিবে।'
তিনি বলেন, আমি আমার সন্তানের মরদেহ একবার দেখতে চাই। আর যারা আমার ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছে, তাদের বিচার চাই।
আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া বলেন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ প্রথমে পোল্যান্ড নেয়ার কথা বললেও— প্রায় দেড় বছর ঘুরানোর পর জানায়, পোল্যান্ডের ভিসা পাওয়া যাবে না। পরে জানায় রাশিয়ায় ভালো কাজের ভিসা আছে। ওই প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করেছে বলেই আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল আমার ছেলে। এখন আমি কীভাবে সংসার চালাব, কীভাবে দেনা পরিশোধ করব— তা বুঝতে পারছি না।
স্থানীয় বাসিন্দা বাকের আহমেদ খান বলেন, পরিবারের জন্য যে সুখের খোঁজে প্রবাসে পাড়ি জামান তরুণরা, শেষপর্যন্ত দালালের প্রতরণার কারণে কেউ ফিরেন সর্বশান্ত হয়ে, কেউবা হারান জীবন। তাই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দিতে হবে। নাহলে এভাবেই আকরামের মতো তরুণরা পরিবারের জন্য সুখ আনতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে প্রাণ হারাবে।
আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাফে মোহাম্মদ বলেন, 'আকরামের মরদেহ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। মরদেহটি এখন কোন স্থানে এবং কার হেফাজতে আছে- সে বিষয়ে তথ্য নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়েছে। এবিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।' এক্ষেত্রে নিহতের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।