জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রতিবেদন করায় মানবাধিকারকর্মী-সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুকে হুমকি

জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুকে হুমকি ও হয়রানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সংগঠনটি তার সুরক্ষা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের সরকারের কাছে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাসহ চার দফা দাবি জানিয়েছে।
নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স উল্লেখ করেছে, ঢাকায় এক সমাবেশে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং আল-কায়েদার প্রতীক প্রদর্শন করা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ১৩-১৫ এপ্রিলের মধ্যে একাধিক ফোন কল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকির শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী নুরুজ্জামান লাবু। হুমকিদাতাদের একজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন 'আনসার আল-ইসলাম'-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। ইএই ঘটনার পর নুরুজ্জামান লাবু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জাতীয় সাংবাদিক সংগঠনগুলো তার সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
নুরুজ্জামান লাবু বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন-এর বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত।
তার উল্লেখযোগ্য কাজ-২০১৭ সালে প্রকাশিত বই 'হলি আর্টিজান: আ জার্নালিস্টিক ইনভেস্টিগেশন', যা ঢাকার গুলশানে ২০১৬ সালের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ওপর করা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সাংবাদিক অনুসন্ধান।
২০২৫ সালের ১৪ এপ্রিল নুরুজ্জামান লাবু রাজধানীর শেরে-বাংলা থানায় জিডি করেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ (ডিইউজে) বেশ কয়েকটি জাতীয় সাংবাদিক সংগঠন এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
২০২৫ সালের ১৩ এপ্রিল একটি অপরিচিত নম্বর থেকে একজন কলার বাংলা ট্রিবিউন অফিসে ফোন করে নুরুজ্জামান লাবুর খোঁজ করেন। ওই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ছবিতে নিজের (কলারের) উপস্থিতি থাকার কারণে কলার হুমকি দেন।
পরে সেদিন নুরুজ্জামান লাবু সেই নম্বরে ফোন করলে কলার তাকে নাম ধরে সম্বোধন করেন। কলার জানান, তার কাছে নুরুজ্জামানের ব্যক্তিগত নম্বর রয়েছে এবং তিনি সন্ধ্যায় আবার যোগাযোগ করবেন।
একই দিন সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন 'আনসার আল-ইসলাম'-এর পলাতক নেতা এক ইমেইলের মাধ্যমে একটি অফিসিয়াল প্রতিবাদপত্র পাঠান এবং তা প্রকাশ না করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন।
প্রায় রাত ১০টার দিকে নুরুজ্জামান লাবু আরেকটি ফোনকল পান, যেখানে নিজেকে 'মির ফরহাদ" বলে পরিচয় দেওয়া একজন ব্যক্তি আগ্রাসী ভঙ্গিতে জানতে চান কেন তার ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। নুরুজ্জামান লাবু তাকে জানান যে, তিনি (কলার) ওসামা বিন লাদেনের ছবি নিয়ে তিনি একটি সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। তাই তার ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
কলার আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর পক্ষ নিয়ে বলেন, তারা এসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করেন না। তিনি দাবি করেন, এই ধরনের কর্মকাণ্ড কোনো আইনে শাস্তিযোগ্য নয়।
এরপর কলার ধর্মীয়ভাবে অবমাননাকর মন্তব্য করতে থাকেন। তিনি নুরুজ্জামান লাবুর পরিচয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাকে ব্যক্তিগতভাবে হুমকি দেন এবং প্রতিবেদনে উদ্ধৃত এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য দাবি করেন—লাবু যা দিতে অস্বীকৃতি জানান। সবশেষে কলার সরাসরি তাকে 'শেষ' করে ফেলার হুমকি দেন।'
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের ১১ এপ্রিল বাংলা ট্রিবিউন-এ নুরুজ্জামান লাবুর লেখা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল: 'আইএস ও আল-কায়েদার পতাকা নিয়ে মিছিল: ক্ষুণ্ন হচ্ছে ভাবমূর্তি।'
ওই প্রতিবেদনে একটি সমাবেশে আইএস ও আল-কায়েদার প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর, নুরুজ্জামান লাবুকে অনলাইনে এবং ফোনে ভয়ভীতি দেখানো এবং হুমকির শিকার হয়েছেন।
ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স নুরুজ্জামান লাবুর সুরক্ষা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্যই তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে মানবাধিকার সংস্থাটি চারটি দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- নুরুজ্জামান লাবুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া, হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নির্ভয়ে কাজ করার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি বিবৃতি দেওয়া এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অঙ্গীকার অনুযায়ী সব মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিককে হুমকি ও হয়রানি ছাড়া কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা।