ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বাংলাদেশ কী সুফল পাবে

২০২৫ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরে আক্রমণ বন্ধের জন্য একটি অস্থায়ী চুক্তিতে পৌঁছায়। এ চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে বসে ছিল বাংলাদেশ। কারণ কৃষ্ণসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুট। তবে চুক্তিটির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের আগে রাশিয়ার মূল দাবিগুলো মেনে নেয় কি না, তার ওপর। এই চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধের মতো জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে; পাশাপাশি কমতে পারে খাদ্য, সার ও জ্বালানির দাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষ্ণসাগর যুদ্ধবিরতি যুদ্ধরত দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সহজ করবে, কমাবে ফ্রেইট খরচ। উভয় পক্ষই নীতিগতভাবে একে অপরের জ্বালানি অবকাঠামো সংরক্ষণে সম্মত হওয়ায় জ্বালানির দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে এলএনজি, কয়লা, খাদ্য ও সারের দাম কমে যাবে—যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙা করবে।
কৃষ্ণসাগরে অবাধ নৌ চলাচল নিশ্চিত, মস্কোর ওপর থেকে সুইফট নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, রোসেলখোজব্যাংক এবং মাছ ও সারসহ বৈশ্বিক খাদ্য বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি করেছে ক্রেমলিন। এছাড়া বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার খাদ্যপণ্য ও সার রপ্তানি উন্মুক্ত করা এবং রাশিয়ার জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ বিমা খরচ কমানোর দাবিও করেছে ক্রেমলিন। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মস্কোর ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন সংঘাতের অবসান ঘটাতে চাইছেন, তখন তার প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ইঙ্গিত দেয়; তবে নতুন পদক্ষেপেরও হুমকি দেয়। ট্রাম্প যদিও স্বাধীনভাবে বেশিরভাগ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারেন, তবে কঠোরতম বিধিনিষেধগুলো প্রত্যাহারের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। আর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২২ সাল থেকে কৃষ্ণসাগরে বাণিজ্য ব্যাহত করছে। এই শান্তি চুক্তির লক্ষ্য এ পথে বলপ্রয়োগ এবং বাণিজ্যিক জাহাজের সামরিক ব্যবহার বন্ধ করা। বিভিন্ন বৈশ্বিক শক্তির মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা এখনও ফলপ্রসূ হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'যুদ্ধবিরতি খুবই ইতিবাচক উদ্যোগ। দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর সেখানে শান্তির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম রুটে অনিশ্চতা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছিলো। কৃষ্ণসাগরকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে জাহাজভাড়া বেড়ে যায়। পণ্যের দামও বেড়ে যায়। বিশেষ করে জ্বালানি তেল ও গমের দামে বেশ প্রভাব পড়েছে।'
রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল, খাদ্যশস্য, সার, ধাতু ও রাসায়নিকসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
'এই যুদ্ধবিরতির চুক্তি কার্যকর হলে এখন এসব পণ্যের দাম কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বৈশ্বিকভাবে যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে,' বলে মোস্তাফিজুর রহমান।
জটিল চুক্তি
বর্তমান মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটি বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হলেও ক্রেমলিন ও ইইউর পরস্পরবিরোধী দাবির কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
রিয়াদে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পর ক্রেমলিন কিছু দাবি পেশ করে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রুশ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মার্কিন ও ইইউ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, তাদের সুইফটে ফিরিয়ে নেওয়া এবং খাদ্য, সার, জাহাজ ও কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, ইউক্রেন থেকে সমস্ত রুশ সেনা প্রত্যাহার রাশিয়ার ওপর থেকে ইইউ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা সংশোধনের অন্যতম শর্তগুলোর একটি হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গতকাল বলেছেন, রাশিয়ার দাবিগুলো আমেরিকা মূল্যায়ন করবে। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি আশা করেন, রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র 'দৃঢ় অবস্থান নেবে'। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি রিয়াদে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে 'ফাঁকা প্রতিশ্রুতি' দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাশিয়ার শর্তগুলো একবারে না হলেও ধীরে ধীরে মেনে নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
তারা বলেছেন, এই চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। রাশিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যপণ্য ও সারের সরবরাহ বাড়বে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম কমতে যারে। এর বড় সুফল পাবে বাংলাদেশ। সাধারণত জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার সঙ্গে বিশ্ববাজারে এলএনজি ও কয়লার দামও ওঠানামা করে। ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে সরকারের ভর্তুকি কমবে, কমবে বেসরকারি খাতের পরিবহন খরচও। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফিরবে।
কৃষ্ণসাগরে অস্থিতিশীলতা ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশে
কৃষ্ণসাগর রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান সামুদ্রিক রুটের সঙ্গে সংযুক্ত করে—যা তেল, গ্যাস ও কৃষিপণ্যের মতো পণ্যগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসেবে কাজ করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের আমদানি, বিশেষ করে গম ও সারের আমদানি ব্যাহত করেছে। ফলে পণ্য দুটির দাম বেড়ে গেছে।
রুশ ব্যাংকগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য লেনদেন আরও জটিল হয়ে পড়ে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া।
রাশিয়া এখন বাংলাদেশ কাছে সুদ ও ফি হিসাবে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পাওনা। এর ফলে প্রকল্পটি বিলম্বিত হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে সাম্প্রতিক অর্থপ্রদানের প্রচেষ্টা নিউইয়র্কের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আটকে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন কর্মকর্তা বলেন, সুইফট সিস্টেমে রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে রূপপুর ঋণ লেনদেনের জটিলতা দূর হবে।
সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, রাশিয়ার ওপর থেকে সুইফট লেনদেনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে রুপপুরের পেমেন্ট শুরু করা যেতে পারে। যদিও তাতে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকবে, তবে রোসাটম থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মসৃণভাবে লেনদেন করা যাবে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি কর্পোরেশন রোসাটম রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
তৈরি পোশাক খাতের ওপর প্রভাব
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পোশাক প্রস্তুতকারকরা বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৪ শতাংশ তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি বাজার রাশিয়ায়। কৃষ্ণসাগর সংকটের কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ঘুরে রাশিয়ায় পণ্য পাঠানো হতো। এতে কমে যায় রপ্তানির পরিমাণ।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'কৃষ্ণসাগর সমস্যার সমাধান হলে রাশিয়ায় সংকটে পড়া রপ্তানি বাজার আবার আলোর মুখ দেখবে। বাড়বে পোশাক রপ্তানি।'
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) ভাইস-প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন টিবিএসকে বলেন, 'আমেরিকা যদি রাশিয়ার ওপর থেকে স্যাংশন তুলে নেয়, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাত দারুণভাবে উপকৃত হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ায় পোসাক রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই সম্ভাবনাকে সংকটে ফেলে দেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমাদের প্রচুর পরিমাণে খাদ্যপণ্য আমদানি হয়। বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে খাদ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তৈরি হয় খাদ্য সংকটও। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে বাড়তি মূল্য কমে আসবে। স্বাভাবিক হবে আমদানি-রপ্তানি।'
জ্বালানি তেলের ওপর প্রভাব
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে। যুদ্ধের সময় তা বেড়ে ১৩০ ডলারে উঠে এখন ৭০-৭২ ডলার রয়েছে।
'রুশ তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জ্বালানি তেল উত্তোলন বাড়ালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় চলে আসতে পারে। এতে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে এলএনজি ও কয়লার দামও কমে। ফলে রাাশিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ ব্যাপক লাভবান হবে। এতে বেসরকারি খাতের জ্বালানি ও পরিবহন খরচ কমবে।'
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানও অনেকটা জাহিদ হোসেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, 'কৃষ্ণসাগরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি হলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে বাংলাদেশও তার সুবিধা পাবে। কারণ বাংলাদেশ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত উভয় জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেই শতভাগ আমদানিনির্ভর দেশ।'