চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধি; ৩,১০০ কোটি টাকার প্রস্তাব বিনিয়োগ সম্মেলনে

সম্প্রতি শেষ হওয়া 'বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫' এ প্রায় ৩,১০০ কোটি টাকার প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা পড়েছে। পাশাপাশি, বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে সফল হয়েছে এই আয়োজন— এমনটাই জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আয়োজিত এ সামিটে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধি ছিলেন চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে। একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ ১৪৭ জনের প্রতিনিধি দল পাঠায় চীন।
চার দিনব্যাপী এ সামিটের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এতে ৩,৫০০–এর বেশি অংশগ্রহণকারী সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সামিটে ব্রেকআউট সেশন, উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক এবং খাতভিত্তিক নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ ছিল।
গতকাল (১৩ এপ্রিল) রাজধানীতে বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, "আমি চিন্তিত নই সামিটে কত বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব এলো। আমি গুরুত্ব দিয়েছি বাংলাদেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারিদের সঠিক ধারণা দিতে। তারা বিনিয়োগ করুক, বা না করুক, বাংলাদেশ নিয়ে ভালো কথা বলুক। খারাপ কথা না বলুক।"
তিনি বলেন, "আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি পজিটিভ ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করেছি, একটি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ করবো।"
৭–৮ এপ্রিল ঢাকায় ও চট্টগ্রামে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন প্রায় ৭০ জন বিনিয়োগকারী। এতে তারা বাংলাদেশের বিনিয়োগ অবকাঠামো সম্পর্কে সরাসরি ধারণা লাভ করেন। এ সময়ে ঢাকায় স্টার্টআপদের জন্যও বিশেষ সেশন আয়োজন করা হয়।
৯ এপ্রিল সামিটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ৭১০ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজ করতে বিভিন্ন নীতিগত সংস্কারের বিষয়।
গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা
সামিটে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে মহাকাশ সহযোগিতায় ঐতিহাসিক এক মাইলফলক হিসেবে বাংলাদেশ 'নাসা আর্টেমিস অ্যাকর্ড'-এ যোগ দিয়েছে। এছাড়া, পিআরএন ও এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপের মধ্যে একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার অর্থায়নে সহায়তা দেবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)।
এছাড়া, দায়িত্বশীল বিনিয়োগ ও শ্রম মানোন্নয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও বিডার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সহযোগিতার জন্য সোলার পাওয়ার ইউরোপ ও বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউএবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, যা দেশের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উদ্যোগকে আরও বেগবান করবে।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে সহায়তার অংশ হিসেবে 'বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস সিড পার্টনারশিপ' স্বাক্ষর করেছে সিড নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন, যা উদ্ভাবনী বীজ প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
সবশেষে, কৃষি প্রযুক্তি ও খাদ্য উৎপাদনে উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ডাচ গ্রিনহাউস ডেল্টা ও এসিআই'র মধ্যে 'গ্রিনহাউস ইমপ্যাক্ট ক্লাস্টার' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে
আশাবাদের মধ্যেও বিনিয়োগকারীরা কিছু চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছেন—বিশেষ করে কারখানার লাইসেন্স, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে দুই বছর পর্যন্ত বিলম্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "এসব বাধা ব্যবসার গতি ধরে রাখা কঠিন করে তোলে। তবে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়া সহজ করতে আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিনের কিছু ভুল ধারণা ভাঙতেই এই সামিটের আয়োজন। অনেক অতিথিই আমাদের সামিটের সংগঠিত রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছেন এবং পরেরবার তাদের অংশীদার ও সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন।"
সামিট আয়োজনের ব্যয় ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে দেড় কোটি টাকা দিয়েছে সরকার এবং বাকি অর্থ এসেছে অংশীদার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে।
আশিক চৌধুরী বলেন, "যদি প্রথমবার আসা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও নিশ্চিত হয়, তাহলেই এটিকে একটি ব্যতিক্রমী সাফল্য বলা যাবে।"