প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় টিউলিপ-হাসিনা-রেহানার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং শেখ রেহানার দুই মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার একটি আদালত।
রোববার (১৩ এপ্রিল) ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের দেয়া চার্জশিট গ্রহণ করেন। আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
উল্লেখ্য, দেড় দশক দেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর থেকে সেখানেই রয়েছেন তিনি।
এর আগে দ্য মেইল অন সানডে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আজই (১৩ এপ্রিল) দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে বাংলাদেশের একটি আদালত।
গত সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঢাকার আদালতে টিউলিপ সিদ্দিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। আজ রাজধানীর সিনিয়র স্পেশাল জজ কোর্টে এসব অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে ৪২ বছর বয়সি এমপি টিউলিপের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেন বিচারকরা।
এই মামলায় দুদক অভিযোগ করেছে, ব্রিটিশ এমপি হিসেবে টিউলিপ তার প্রভাব খাটিয়ে শেখ হাসিনাকে দিয়ে নিজের মা শেখ রেহানা, ভাই রেদওয়ান ববি সিদ্দিক ও বোন আজমিনা সিদ্দিকের জন্য রাজধানীর পূর্বাচলে নিজের প্লট বাগিয়ে নেন। এই তিনজনই বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন।
তবে টিউলিপ ও তার পরিবার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দুদকের অভিযোগ, টিউলিপের সিদ্দিকের চাপে শেখ হাসিনা রাজধানীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৬ হাজার ২১৩ একরের 'পূর্বাচল নিউ টাউন প্রোজেক্ট'-এ তাদের প্রত্যেককে একটি করে প্লট বরাদ্দ দেন।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে টিউলিপ এমপি থাকা অবস্থায় বিদেশি কোনো মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে বিবেচিত হবেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রত্যর্পণের আবেদন করতে পারবে।
হাসিনা ও টিউলিপের পরিবারের ছয় সদস্যসহ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
গত মাসে টিউলিপের আইনজীবীরা দুদককে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেন, এই তদন্ত 'টার্গেটেড এবং ভিত্তিহীন'। তারা অভিযোগ করেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ 'মিথ্যা ও হয়রানিমূলক'।
তবে গত সপ্তাহে দুদক চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন বলেন, টিউলিপের সঙ্গে কোনো চিঠি চালাচালি করবে না কমিশন। বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে।
তিনি বলেন, 'চিঠি চালাচালি বিচারিক প্রক্রিয়ার বিকল্প হতে পারে না। বিস্তারিত নথি পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষয়টি এখন সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ারে আছে। পরোয়ানা জারির পরও যদি তিনি হাজির না হন, তাহলে তাকে পলাতক আসামি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।'
উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারিতে টিউলিপ সিদ্দিক সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার এক মাস আগে ডেইলি মেইল-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, টিউলিপ ও তার পরিবারের সদস্যরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন, এমন অভিযোগে দুদক তার বিরুদ্ধে প্রথম দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে। যদিও টিউলিপ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এরপর জানা যায়, লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিক যে ফ্ল্যাটগুলোতে থাকেন, সেগুলো তার খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্ররা তাকে উপহার দিয়েছেন।
এক অফিসিয়াল তদন্তে উঠে আসে, টিউলিপ ২০২২ সালে মেইল অন সানডেকে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা কিনে দিয়েছেন বলে যে তথ্য দিয়েছিলেন, সেখানে মিথ্যা বলে থাকতে পারেন।
পরে অবশ্য টিউলিপ স্বীকার করেন, ওই ফ্ল্যাট ছিল তার স্বৈরশাসক খালার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এক প্রভাবশালী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর উপহার।
টিউলিপ মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর দুদক নতুন করে শুরু করে পূর্বাচল প্রকল্প নিয়ে তদন্ত শুরু করে। একইসঙ্গে ২০০২ সাল থেকে টিউলিপের মালিকানায় থাকা ঢাকার একটি ফ্ল্যাট নিয়েও আরেকটি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
টিউলিপ দাবি করেন, তিনি ২০১৫ সালে—এমপি কয়েকদিন পরেই—ওই ফ্ল্যাট বোনের নামে হস্তান্তর করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু দুদকের দাবি, তিনি আসলে ফ্ল্যাটটির মালিকানা হস্তান্তর করেননি। বরং একটি ভুয়া হস্তান্তর দলিল তৈরি করেছিলেন।
গত মাসে মেইল অন সানডে ঢাকার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয়, ঢাকার ওই ফ্ল্যাটের মালিক এখনও টিউলিপ।
তবে টিউলিপ এ বিষয়ে বলেন, তিনি সম্পূর্ণ 'বৈধ উপায়ে' বাংলাদেশি আইন অনুসারে ফ্ল্যাটটি বোনকে দিয়েছেন।
গত রাতেও আইনজীবীদের মাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে টিউলিপ বলেন, দুদক তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, তা 'সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন' এবং তার আইনজীবীরা লিখিতভাবে সব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দুদক টিউলিপের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি, এমনকি সরাসরি তাদের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগও করেনি।
টিউলিপ ঢাকায় কোনো শুনানির ব্যাপারে কিছুই জানেন না দাবি করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, 'তার বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি কোনো ভিত্তি নেই'।