চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও দুই নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা সরকারের

বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত বিদ্যমান চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চলের (সিইআইজেড) পরিপূরক হিসেবে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষভাবে আরও দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অফ চায়না লিমিটেড (পাওয়ারচায়না)—চীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা—যা গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট (জি২জি) চুক্তির আওতায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় ৩ হাজার 0৩৮ একর জমির ওপর 'চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-১' গড়ে তুলবে।
অন্যদিকে, 'ভোলা ইকো-ডেভেলপমেন্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল'টি ভোলা সদর ও দৌলতখান উপজেলায় হবে এবং এটি পরিচালিত হবে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকী চীনা প্রতিষ্ঠান 'লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড'-এর মাধ্যমে। এটি বেসরকারিভাবে এই অঞ্চলটি তৈরি করবে।
সভাসূচি অনুযায়ী, রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বেজার গভর্নিং বোর্ডের সভায় নয়টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে দুটি অঞ্চল চীনা বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসন্ন সভায় বেজার ব্যবস্থাপনায় থাকা পরিত্যক্ত পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকলের জমি বরাদ্দের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে অঞ্চলগুলোকে বিনিয়োগবান্ধব করে তোলা যাবে।
চীনা-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল
বেজা ইতোমধ্যে আনোয়ারায় ২০১৬ সাল থেকে উন্নয়নাধীন চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চলের জন্য একটি বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। কর্মকর্তারা আশা করছেন, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আসন্ন সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পাবে।
আনোয়ারার চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে, ভোলা ইকো-ডেভেলপমেন্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১.৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-১-এর জন্য বিনিয়োগের চূড়ান্ত পরিমাণ একটি প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে বলে বেজার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বেজার নথি অনুযায়ী, চাঁদপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল-১ মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী একটি চরে অবস্থিত। বর্তমানে চরটির সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের নিয়মিত জলপথ সংযোগের অবকাঠামো নেই, ফলে পরিবহনের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
এই লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের কারণে ঐ অঞ্চলে প্রচলিত শিল্প ও উৎপাদন খাতের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর চাঁদপুর অঞ্চলের বিনিয়োগ সম্ভাবনা মূল্যায়নের জন্য একটি প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে।
বেজা আশা করছে, ভোলা ইকো-ডেভেলপমেন্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক, টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক্স এবং সিরামিক শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের বড় সুযোগ তৈরি হবে, যা প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।
চীনা বিনিয়োগে আগ্রহ বৃদ্ধি
বেজার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করায় রপ্তানিমুখী চীনা কোম্পানিগুলো বিকল্প বিনিয়োগ গন্তব্য খুঁজছে।
এছাড়া, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতে কাঁচামাল সরবরাহকারী চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন কারখানা স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানিয়েছেন, আগামী মাসে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০০ সদস্যের একটি চীনা ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে এবং বিনিয়োগ সম্ভাবনা পর্যালোচনা করবে। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছে।
বিডার এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিনিধিদলের অধিকাংশ সদস্যই টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক শিল্পে কাঁচামাল রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত।
এই কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করে এবং তারা অভ্যন্তরীণ খরচ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করলে তুলনামূলকভাবে কম খরচে কাঁচামাল সরবরাহ সম্ভব হবে—যা তাদের সরাসরি বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়াবে।
চীনা প্রতিনিধিদলের সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ
বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানিয়েছেন, চীনের ইউনান প্রদেশের এক ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সেখানকার একজন উচ্চপদস্থ নেতা, আগামী মাসে বাংলাদেশ সফর করবেন।
এই প্রতিনিধিদল এর আগে গত বছরও বাংলাদেশ সফর করেছিল এবং এসিআই, এনার্জিপ্যাকসহ অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে মোটরগাড়ি ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছিল।
'তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগ পরিকল্পনার অগ্রগতি থমকে গিয়েছিল,' মৃধা বলেন।
তিনি আরও জানান, এবার প্রতিনিধিদলটি পুনরায় বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশে আসছে।
মৃধা আরও বলেন, অনেক চীনা বিনিয়োগকারী এখন বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেক্সটাইল ও আরএমজি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিযন্ত্র শিল্প এবং নীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে।