খুলনার তরমুজ, আকারে ছোট হলেও মিষ্টি ভীষণ

তরমুজের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন বাজারে বড় আকারের বাহারি তরমুজে পসরা জমেছে। তবে খুলনার তরমুজ আকারে ছোট হলেও স্বাদে এগিয়ে। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের চাষ করা এই তরমুজ এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা, আর খাঁটি মিষ্টি স্বাদের তরমুজ পেয়ে সন্তুষ্ট ক্রেতারাও।
খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলে চাষ হচ্ছে এই বিশেষ তরমুজ। কৃষকদের ভাষ্য, এলাকার মাটির গঠন ও সঠিক জাত নির্বাচনই তরমুজের স্বাদের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও এর ভেতরের রঙ লালচে, স্বাদ মিষ্টি এবং রসালো হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা বাড়ছে।
গড়াইখালির কৃষক শান্ত মণ্ডল এবার ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের জমির মাটি একটু বালুকাময়, রোদও ভালো পড়ে। তাই তরমুজে চিনি জমে বেশি। আকারে ছোট হলেও খেলে বোঝা যায়, আসল স্বাদ কাকে বলে।'
তিনি জানান, সাধারণত প্রতি গাছে ১টি বা ২টি তরমুজ রাখা হয়। গাছ বড় হলে ৩টি রাখা হয়। একটি গাছে একটি তরমুজ রাখলে সেটি আকারে বড় হয়, তবে সংখ্যা বাড়লে আকারে ছোট হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, খুলনায় চলতি মৌসুমে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হচ্ছে। উৎপাদন হবে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। বাজারমূল্য দাঁড়াবে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি।
খুলনার তরমুজ কেন মিষ্টি—এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের সিনিয়র মনিটরিং কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, 'এখানকার উপকূলীয় এলাকার মাটি অনেক জায়গায় বালুকাময় ও ঝুরঝুরে। পানি সহজে নিষ্কাশিত হয়, শিকড় গভীরে প্রবেশ করে গাছ পুষ্টি পায় ভালোভাবে। এতে তরমুজ মিষ্টি হয়। পাশাপাশি, প্রচুর সূর্যালোক গাছের সালোকসংশ্লেষণ বাড়িয়ে তরমুজে চিনি জমাতে সহায়তা করে।'

তিনি আরও জানান, স্থানীয় কৃষকরা এখন এমন জাতের তরমুজ বেছে নিচ্ছেন, যেগুলো লবণাক্ত মাটিতে ভালো ফলন দেয় এবং মিষ্টিও হয়। অনেকেই এখন জৈব সার, কম রাসায়নিক ও সেচ ব্যবহারে মনোযোগ দিচ্ছেন। এতে মাটির গুণমান ও ফলের স্বাদে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
খুলনার শান্তিধাম মোড়ে ১০ বছর ধরে মৌসুমে তরমুজ বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী মো. রুহুল। তিনি বলেন, 'দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা খুলনায় এসে সরাসরি তরমুজ কিনছেন। বাজারে খুলনার তরমুজের আলাদা চাহিদা আছে। এগুলো বিক্রি হয় "মিষ্টি তরমুজ" নামে।'
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনার কৃষকরা আগে তরমুজ চাষে অভ্যস্ত ছিলেন না। ১৯৯৭ সালে সরকারের প্রণোদনায় দাকোপ উপজেলার বাজুয়া গ্রামের রবি কয়াল ও পঙ্কজ কয়াল প্রথম তরমুজ চাষ করেন। তাদের দেওয়া হয় বিনামূল্যে বীজ ও সার।
সেবার ভালো ফলন হওয়ায় তাদের দেখাদেখি আরও কৃষক চাষে আগ্রহী হন। ২০১৫ সালের পর থেকে দাকোপ উপজেলার সব ইউনিয়নে ও চালনা পৌরসভায় তরমুজ চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায়ও এর প্রসার ঘটে।
খুলনার তরমুজ সাধারণত এপ্রিলের শুরু থেকে বাজারে আসে। এর ২০-৩০ দিন আগে পটুয়াখালীর তরমুজ বাজারে আসায় মৌসুমের শুরুতে ওই অঞ্চলের কৃষকরা ভালো দাম পান।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, খুলনায় প্রধানত তিন ধরনের তরমুজ চাষ হয়—সবুজ (সাদা), কালো (ব্লাক কুইন), এবং সাদা-কালো সংমিশ্রিত 'বাংলালিংক' বা 'ড্রাগন' জাত। এর বাইরেও কেউ কেউ হানিডিউ জাতের তরমুজ চাষ করেন, যার বাইরের রং হলুদ হলেও ভেতরে লাল এবং স্বাদে বিশেষ।
চাষিরা আরও জানান, চলতি মৌসুমে সাদা ও কালো সংমিশ্রিত ড্রাগন, ড্রাগন সুপার, আস্থা, আস্থা প্লাস, পাকিজা, মালিক-১, এশিয়া সুপার, থাই রেড কিং, বাংলালিংক ও বিগ সুপার কিং জাতের তরমুজ বেশি পরিমাণে চাষ করা হয়েছে।