সংবিধানে স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে: উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে শুধু গরু-ছাগল মোটাতাজাকরণ কেন্দ্রিক মন্ত্রণালয় হিসেবে না দেখে 'পুষ্টি মন্ত্রণালয়' হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রণালয়টির উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রাণী অসুস্থ থাকলে মানুষও সুস্থ থাকতে পারে না। অপুষ্টির পেছনে অন্যতম কারণ আমিষ গ্রহণের ঘাটতি।
ফরিদা আখতার বলেন, সংবিধানে আমাদের স্বাস্থ্যের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ভোট বা বাকস্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হলেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোচনায় নেই। ফলে সংবিধানে জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।
বুধবার (৯ এপ্রিল) বিকেল ৪টায় জুমে 'স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি মৌলিক মানবাধিকার' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। ওয়েবিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে সেন্টার ফর ল' অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্স (সিএলপিএ), পাবলিক হেলথ লইয়ার্স নেটওয়ার্ক ও স্বাস্থ্য আন্দোলন।
ফরিদা আখতার বলেন, জুলাইয়ে আহত অনেক তরুণের শরীরে ১২-১৩টি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টার্ড পাওয়া গেছে, যা ভয়াবহ। কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক এবং প্রাণীর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে এমনটা হচ্ছে। আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের অধিকার চাই। কিন্তু বিগত সরকার স্বাস্থ্য নয়, রাজস্ব আদায়ের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এখন স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে, তবে স্বাস্থ্যখাতে মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, 'জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিটি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠানো উচিত।'
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সল বলেন, স্বাস্থ্যসেবা কতটুকু পাওয়া যাবে তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে সহজ প্রবেশাধিকার এবং গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ, সচেতনতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ও অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, দেশে মেগা প্রকল্পে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, স্বাস্থ্যখাতে সেভাবে দেওয়া হয় না। চিকিৎসা নিতে গিয়ে যেন কেউ অর্থকষ্টে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি বলেন, 'সরকার চিকিৎসায় যথাযথ ব্যয় না করলে মানুষ বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকবে এবং ব্যয়ও বেড়ে যাবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে করতে হবে এবং ইমার্জেন্সি কেয়ারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।'
নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরিন বলেন, নারী স্বাস্থ্য নিয়ে দেশে শোষণ ও বৈষম্য রয়েছে। অর্থায়নে ঘাটতির পাশাপাশি আইন-নীতিমালাতেও নারীর স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, নারীর প্রতি অবহেলার কারণে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হচ্ছে না। নারীস্বাস্থ্যকে মানবাধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার পাশাপাশি সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ওয়েবিনারে আলোচকেরা বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে সংবিধানে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে অংশীজনের অংশগ্রহণে সমন্বিত কার্যক্রম নিতে হবে। প্রত্যেকের দায় ও কর্তব্য নির্ধারণ ও ব্যাখ্যা করা জরুরি। বৈষম্যহীন ও বিনামূল্যে প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করে এর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত সংসদীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নাগরিক, মিডিয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
ওয়েবিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন উবেনীগের পরিচালক সীমাদাস সীমু, জনস্বাস্থ্য গবেষক ও সাংবাদিক সুশান্ত সিনহা এবং পাবলিক হেলথ লইয়ার্স নেটওয়ার্কের সদস্য-সচিব ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিএলপিএ-এর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম এবং মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক (গবেষণা) ড. শরীফ আহমেদ চৌধুরী।