৯ দিনের ঈদ-ছুটিতে পর্যটনখাতে প্রাণচাঞ্চল্য

ঈদে এবার লম্বা ছুটিতে দেশীয় পর্যটনে প্রাণচাঞ্চল্য আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। টানা ৯ দিনের ছুটিতে অনেকেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করায় অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতে এবার ভিড় বাড়বে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন পর্যটন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানান, ইতোমধ্যে দেশের হোটেল ও মোটেলের প্রায় ৭০ শতাংশ রুম অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। অনেকে আবার সরাসারি গিয়েও রুম ভাড়া নিচ্ছেন। ফলে ঈদের এই ছুটিতে শতভাগ বুকিং আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজারে রমজান মাসজুড়ে পর্যটকশূন্য অবস্থা বিরাজ করছিল। সৈকত ছিল প্রায় ফাঁকা, আবাসিক হোটেল-মোটেলগুলোয় কাটছিল অলস সময়। তবে ঈদুল ফিতরের দীর্ঘ ছুটিতে ফের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছে পর্যটন নগরীতে—এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার (২৮ মার্চ) থেকে শুরু হওয়া ঈদের ছুটিতে দেশবাসী পাচ্ছেন টানা ৯ দিনের ছুটি। যদিও ছুটির শুরুতে পর্যটকের চাপ কম ছিল, তবে ১ এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজারে ব্যাপক ভিড়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজারের প্রায় ৫ হাজার হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও রিসোর্টে রুম অগ্রিম বুকিং শুরু হয়ে গেছে। শুক্রবার পর্যন্ত তারকামানের অনেক হোটেলের কক্ষ শতভাগ বুক হয়ে গেছে। অন্যান্য আবাসিক হোটেলেও ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার আবাসিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, "১ এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে ব্যাপক পর্যটকের আগমন ঘটবে। ইতোমধ্যে রুম বুকিং শুরু হয়েছে। ধারণা করছি, এই পাঁচ দিনে সাড়ে ৭ লাখের মতো পর্যটক কক্সবাজারে ভিড় জমাতে পারেন।"
হোটেল সী-গালের ব্যবস্থাপক এনায়েত উল্লাহ বলেন, "ঈদের পরের দুদিন আমাদের সব রুম শতভাগ বুক হয়ে গেছে। এরপরের দিনগুলোর জন্য বুকিং চলছে। আশা করছি, ঈদের পরবর্তী পুরো সপ্তাহ জুড়েই কক্সবাজার পর্যটকে মুখর থাকবে।"
হোটেল কক্স-টুডের ব্যবস্থাপক আবু তালেব শাহ বলেন, হোটেলের মেরামত, সুইমিং পুল পরিষ্কার এবং রুমে রঙের কাজ শেষ হয়েছে। এখন পুরোপুরি প্রস্তুত আছেন পর্যটকদের স্বাগত জানাতে। রুম বুকিংও চলছে।
লাবণী পয়েন্টের বার্মিজ পণ্যের ব্যবসায়ী আব্দু রশিদ বলেন, "রমজানে পর্যটক না থাকায় দোকানের মেরামতের কাজ করেছি। এখন নতুন পণ্য—যেমন আচার, বাচ্চাদের খেলনা, জুতা, কাপড় ইত্যাদি সাজানোর কাজ করছি। আশা করছি, এবারের ঈদে ভালো বিক্রি হবে।"
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতলেব শরীফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "এবার লম্বা ছুটি হওয়ায় কুয়াকাটায় পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় হবে বলে আশা করছি। এতে আমাদের সদস্যদের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। আমাদের সদস্য সংখ্যা ৮০ জন। আমাদের হোটেলগুলোতে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সদস্যদের বাইরে সব মিলিয়ে কুয়াকাটায় মোট প্রায় ২০০টি হোটেল রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতি বছর এখানে গড়ে ৫০ হাজারের মতো পর্যটক আসেন।"
তিনি আরও বলেন, "কিছু হোটেলে ৫০ শতাংশ আবার কিছু হোটেলে ১০০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। তবে ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম বুকিং না থাকলেও শেষমেশ সব হোটেলই কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায়। এবার বেশি ছুটি থাকায় পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছি।"
বান্দরবান হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, "এবার গত বছরের তুলনায় পর্যটকদের সাড়া বেশি মিলছে। বান্দরবান সদরে প্রায় ৭০টি হোটেল রয়েছে এবং এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রুম ইতোমধ্যে অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার পর্যটক অবস্থান করতে পারেন।"
তবে সম্প্রতি সাজেক ভ্যালিতে আগুন লাগার কারণে সেখানে পর্যটকদের আগ্রহ কিছুটা কমেছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন (টোয়াব)–এর সভাপতি মোহাম্মদ রফিউজ্জামান বলেন, "এবার ছুটি বেশি হওয়ায় অনেকে গ্রামের বাড়িতে যাবেন এবং সেখান থেকে কাছাকাছি পর্যটন স্পটে ঘুরতে বের হবেন। ফলে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অতিরিক্ত ভিড় হবে না। এটি পর্যটনের জন্য ইতিবাচক, কারণ অতিরিক্ত ভিড় হলে পর্যটকরা ঠিকভাবে ভ্রমণ করতে পারেন না এবং হোটেল বুকিং পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।"
টোয়াবের সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশি বলেন, সাধারণত ঈদের এই দীর্ঘ ছুটিতে সারা দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ভ্রমণে বের হন। এর মধ্যে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, সিলেটের বিভিন্ন এলাকা—যেমন রাতারগুল, বিছানাকান্দি, জাফলং, তামাবিল, রাঙামাটি ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে।
আকাশপথে যাত্রীর চাপ কম
এবার ঈদে আকাশপথে যাত্রীদের চাপ তুলনামূলকভাবে কম। আগের বছরগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের সব এয়ারলাইন্সকে যাত্রী চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হতো। বাড়তি ফ্লাইটও চালু করতে হতো। তবে এবার ছুটি আগে থেকে শুরু হওয়ায় যাত্রীরা ধাপে ধাপে গন্তব্যে চলে যাওয়ায় চাপ কিছুটা কম পড়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এ বছর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীচাপ কম ছিল। আমাদের অতিরিক্ত কোনো ফ্লাইট দিতে হয়নি।"
তিনি বলেন, "ভারতে পর্যটন ভিসা অনেক দিন ধরেই বন্ধ। যাদের ভিসা ছিল, সেগুলোর মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে যারা চেন্নাই যাচ্ছেন, তারা মূলত মেডিকেল ভিসায় যাচ্ছেন, তাও ৫০ শতাংশ সিট খালি রেখে ফ্লাইট চালাতে হচ্ছে। ওমরার ভিসা না থাকায় জেদ্দা রুটেও চাপ পড়েনি। এ ছাড়া পর্যটন ভিসা না থাকায় দুবাই, আবুধাবি ও শারজাহ রুটে ভ্রমণকারী একটি বড় গ্রুপের চলাচল নেই।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংককে ই-ভিসা চালু হলেও এখন ৪৫ দিন আগেই পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। আগে যেখানে প্রতিদিন ৭০০-৮০০টি ভিসা ইস্যু হতো, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৪০০টির মতো। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের চাপ এবার কম ছিল।"
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "ভারত এখন ট্যুরিস্ট ভিসা দিচ্ছে না। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের ভিসা পেতেও বাড়তি সময় লাগছে। এর ফলে দেশের বাইরে ভ্রমণ কমে যাবে, তবে দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ বাড়বে।"
তিনি জানান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে ভ্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব গন্তব্যের ফ্লাইটগুলো এখন পূর্ণ সক্ষমতায় যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তা
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, "ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে ৭ থেকে ৮ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটতে পারে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ ও যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া বা মূল্য নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।"
তিনি আরও বলেন, "ঈদের ছুটিতে আগত পর্যটকদের ঘিরে কক্সবাজারে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ১৩টি খাতে অন্তত সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে।"
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, "কক্সবাজারে পর্যটকরা যাতে সবসময় নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন, সেজন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ঈদে অতিরিক্ত পর্যটকের আগমনকে সামনে রেখে টহল জোরদার করা হয়েছে। সাদা পোশাকে নজরদারি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অভিযোগ বক্স স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি, পর্যটকরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কক্সবাজার ভ্রমণ করতে পারবেন।"