নির্বিঘ্নে ঈদ ভ্রমণ: দীর্ঘ ছুটি, কার্যকর ব্যবস্থাপনা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এবার

সরকারের সুপরিকল্পিত উদ্যোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পরিবহন কর্তৃপক্ষের সক্রিয় ব্যবস্থাপনার ফলে এ বছর ছুটি কাটাতে যাওয়া যাত্রীরা অন্যরকম নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা উপভোগ করছেন।
এই নির্বিঘ্ন ভ্রমণ অভিজ্ঞতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—সড়কের উন্নতি, এলেঙ্গা-রংপুর এবং ঢাকা-সিলেট ছয় লেনবিশিষ্ট দুটি প্রধান মহাসড়ক খুলে দেয়া, পুলিশের বাড়তি নজরদারি, কার্যকর টোল আদায় ব্যবস্থা এবং সড়কে চাঁদাবাজি না থাকা।
এছাড়া পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরাও এবার ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ও কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, লম্বা ছুটির কারণে মানুষ পর্যায়ক্রমে রাজধানী ছাড়তে পেরেছে। এতে রাস্তায় একসাথে বাড়ি যাওয়া মানুষের ঢল নামেনি; আর তাতেই যানজট কমেছে।
তিনি বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে সবাই একসাথে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করত, যা রাস্তা ও পরিবহনের ওপর সক্ষমতাকে ছাপিয়ে যে। ফলে দেখা দিত বিশৃঙ্খলা। এ বছর মানুষ ধাপে ধাপে বাড়ি যাওয়ায় কর্তৃপক্ষকে আরও ভালোভাবে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, নতুন মহাসড়কগুলোও ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে ভবিষ্যতেও এমন নির্ঝঞ্ঝাট যাত্রা বজায় রাখতে হলে শিল্প ও নগর সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণসহ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন তিনি।
চাঁদাবাজি এবং অতিরিক্ত ভাড়ার বিরুদ্ধে পরিবহন সংগঠনগুলো এবার কড়া অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশও অনেকটা অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের সুরেই কথা বলেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, এ বছর ঈদে মানুষ ধাপে ধাপে ঢাকা ছাড়ায় বাসের টিকিটের ওপর বড় চাপ পড়েনি।
'বরং যাত্রী কম থাকায় কিছু বাসের শিডিউলই বাতিল করতে হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা আর সরবরাহের ভারসাম্য ছিল চমৎকার। ফলে কোনো যাত্রীকেই বিনা টিকিটে ফিরতে হয়নি,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এবার নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রার ফলে আমরা যাত্রীদের ভালো সেবা দিতে পেরেছি। কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করায় আমরা সন্তুষ্ট।'
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এএসএম আহমেদ খোকন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা চাঁদাবাজি এবং ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।'
'আমাদের টিম চাঁদাবাজি ও ভাড়া বৃদ্ধি ঠেকাতে, এবং বাস চলাচল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য টার্মিনালে নজরদারি চালাচ্ছে। কোনো বাস অপ্রয়োজনে থেমে যাত্রী তুলছে না—এতে যানজট কমেছে।'
কর্তৃপক্ষ বলছে, এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবার ঝামেলামুক্ত ঈদযাত্রার জন্য নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। তারা আরও জানায়, এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে আগেভাগেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ঈদের ছুটিতে নির্বিঘ্নে টোল আদায় ও যানবাহন চলাচল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সেতু বিভাগ সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
'সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বিঘ্ন ভ্রমণ নিশ্চিত করতে আমরা ঈদের অনেক আগেই সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেছি। অন্যান্য সব স্টেকহোল্ডাররাও আমাদের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে,' বলেন তিনি।
আবদুর রউফ আরও বলেন, 'টোল আদায় প্রক্রিয়া দ্রুত করতে আমরা সব টোল প্লাজায় বাড়তি জনবল ও অতিরিক্ত বুথ স্থাপন করেছি, যাতে ঈদে প্রত্যাশিত বাড়তি যানবাহন সহজে সামাল দেওয়া যায়।'
সচিব আরও জানান, যেকোনো প্রযুক্তিগত সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে ব্যাকআপ টিম ও সিস্টেম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সড়কে বিকল হয়ে যাওয়া গাড়ির সমস্যা মোকাবিলায় দ্রুত সহায়তাদানকারী টিম রাস্তায় ও সেতু এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।
'সব বড় সেতুর উভয় প্রান্তে রেকার স্থাপন করেছি, যাতে যেকোনো বিকল গাড়িকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নেওয়া যায়,' বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, লম্বা ছুটির কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বাড়তি সুবিধা পাওয়া গেছে। ছুটি লম্বা হওয়ায় যান চলাচল সে অনুযায়ী সামঞ্জস্য রেখে করা গেছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সরকারের জনমুখী উদ্যোগ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার ফলেই এবারের ঈদযাত্রা ঝামেলাহীন হয়েছে।
তিনি বলেন, 'ঈদযাত্রা যেন নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয় এবং ছুটির পর ঢাকায় ফেরা মানুষও নিরাপদে ফিরতে পারেন, সেজন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহসানুল হক বলেন, সরকার সবার জন্য নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পুলিশ ও পরিবহন সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে, যাতে কোথাও কোনো চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বা হয়রানির ঘটনা না ঘটে।