হাসিনা-আমলের দুই কিংস পার্টি: নির্বাচনের সাথে সাথে হারিয়ে গেল রাজনীতির মাঠ থেকে

রাজনীতির মাঠ থেকে যেন হারিয়ে গেছে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আমলে আলোচনায় আসা দুই কিংস পার্টি–জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপি।
গত নির্বাচনের আগেও যারা প্রধান বিরোধীদল হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল, সেই দুই দলই নির্বাচন শেষ হতে না হতেই 'গায়েব' হয়ে গেছে। নির্বাচনেও ভরাডুবি হয়েছিল তাদের। দুই দলের বেশির ভাগ প্রার্থীই পর্যাপ্ত ভোট না পাওয়ায় জামানত হারিয়েছিলেন।
শুরু থেকেই তাদের নিবন্ধন নিয়ে ছিল বিতর্ক। এরপর একটি দলের অফিসের ঠিকানা নিয়ে ছিল সমস্যা। তারপরে নির্বাচনে লজ্জাজনক ভরাডুবি। আর সবশেষে তাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে তাদের উপস্থিতি এখন শুধুই স্মৃতি।
বলা যায়, রাজনীতির এই দুই 'কিংস পার্টি' এখন অস্তিত্বের সন্ধানে। তাদের গল্প যেন রাজনীতির মঞ্চে একটি মজার নাটক—যার শেষ অধ্যায় এখনও লেখা হয়নি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩ সালে মোট ৫টি নতুন দলকে নিবন্ধন দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপি। এই দুটি দল 'কিংস পার্টি' হিসেবে পরিচিতি পায়।
কিন্তু নিবন্ধন পাওয়ার পর থেকেই এই দুই দলকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে তাদের আর কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। তাদের নিয়ে নেই কোনো আলোচনাও। অর্থাৎ, নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই তারা যেন রাজনীতির মাঠ থেকে 'গায়েব' হয়ে গেছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ পতনের পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার কয়েক দফা রাজনৈতিক দলেগুলোর সাথে সভা করলেও কোনোবারেই ডাকা হয়নি এই কিংস পার্টিদেরকে।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিয়ে নাটক
বিএনএমের গল্পটা শুরু হয় মহাখালীতে। একটি চারতলা ভবনের চতুর্থ তলায় দুটি ছোট কক্ষে তাদের অফিস। একটি কক্ষে অফিস, অন্যটিতে ছিল সভাকক্ষ।
কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা গুলশানের একটি আলিশান অফিসে চলে যায়। সেখানে তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রি এবং প্রার্থী বাছাই করা হয়। কিন্তু নির্বাচনের পরের দিন থেকেই সেই অফিসে সুনসান নীরবতা। নেতাকর্মীরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
গুলশানের সেই অফিসের ভাড়া নিয়েও বিতর্ক কম নয়। ফ্ল্যাট মালিক মারফত আলী টিবিএসকে জানিয়েছিলেন, বিএনএমকে তিন মাস ফ্রিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সময়মতো অফিস ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের জোর করে অফিস ছাড়ানো হয়।
এখন বিএনএমের কেন্দ্রীয় অফিসের ঠিকানা মোহাম্মদপুরে। কিন্তু সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেটা একটি আবাসিক ভবন। ছয়তলা ভবনটিতে দলটির কোনো একটি সাইনবোর্ডও নেই। ভবনটির সিকিউরিটি গার্ড জানান, এখানে দলের চেয়ারম্যানের বাসা আছে, অফিসের জন্য একটি রুম আছে। তবে এই মুহূর্তে অফিস তালাবন্ধ। কেউ সেখানে নেই। তাই ওই অফিসে যাওয়ার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে, তৃণমূল বিএনপির অবস্থাও কম নয়। নির্বাচন কমিশনে তাদের অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে পল্টনের মেহেরবা প্লাজায়। কিন্তু ওই ভবনের ১৬তলায় অবস্থিত অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সেটা আসলে একটি উকিল চেম্বার।
লিফট থেকে নেমেই দেখা গেল, আধো আলো, আধো অন্ধকার। ডানপাশের একটি রুমের কাঠের দরজার উপরে বড় করে ল' চেম্বারের নাম দেয়া আছে। দরজার প্রবেশ পথের ডানপাশে ছোট করে নেমপ্লেটের মতো একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের মধ্যে বড় করে লেখা কেন্দ্রীয় কর্যালয়। কিন্তু তার উপরে দেখে অবাক হতে হলো। এই একই উকিল চেম্বার একটি নয়, দুটো পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একটি বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ) এবং অন্যটি তৃণমূল বিএনপি।
দরজা দিয়ে ভেতরে গিয়ে একটি রিসিপশন। তবে সেখানে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেও পাওয়া গেল না কাউকে। পরে পাশের একটি অফিসে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, চেম্বারের লোক ওয়াশরুমে গেছেন। তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। কি কাজে এসেছি সেটাও জানতে চাইলেন। তৃণমূল বিএনপির অফিসে একটি কাজে এসেছি জানালে তিনি বললেন, এখানে দলের কেউ নেই। এখানে দলের কেউ আসেন না।
এদিকে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন তথ্যে তৃণমূল বিএনপি তাদের একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই সাইটেও প্রবেশ করা যায় না। যেন ওয়েবসাইটও তাদের মতোই 'গায়েব' হয়ে গেছে।
নির্বাচনে ভরাডুবি
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনএম এবং তৃণমূল বিএনপি দুটোরই ভরাডুবি হয়েছে। বিএনএম ৫৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল, কিন্তু একজন ছাড়া বাকি সবাই জামানত হারিয়েছেন।
অন্যদিকে, তৃণমূল বিএনপি থেকে নির্বাচন করা ১৩৫ প্রার্থীরও কেউই জয়ী হতে পারেননি। তাদেরও প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
দুই দলের নেতারাও বললেন দলে কার্যক্রম নেই
দুটি দলের কোনোটিরই কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। দল দুটোর নেতাদের মতে, তারা এখন বসে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
বিএনএম ভবিষ্যতে আবারও সক্রিয় হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করলেও, তৃণমূল বিএনপিতে হারানোর সুর।
বিএনএমের চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, "সময়টা অনুকূলে না, তাই আমরা এখন ওইভাবে কোনো কার্যক্রমে নেই। দলের যেসব জায়গায় কমিটি নেই, সেসব জায়গায় এখন কমিটি দিচ্ছি।
"আমরা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। কী হচ্ছে সেটা দেখছি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনে আমাদের দল আবার সক্রিয় হবে," জানান আবু জাফর।
অন্যদিকে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, "আমাদের দলের কোনো কার্যক্রম নেই। এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার দলীয় কোনো পরিকল্পনাও নেই।"
"আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। সংস্কারের দিকে তাকিয়ে আছি। রাজনীতিতে যদি কোনো সংস্কার না হয়, তাহলে তৃণমূল বিএনপি আর কখনও সক্রিয় নাও হতে পারে," বলেন তিনি।
তাহলে কি দলটি হারিয়ে যাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "হ্যাঁ, দলটি হারিয়ে যেতে পারে।"
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "এই দেশের এখনও রাজনৈতিক সমতা আসেনি। নির্দিষ্ট দলের বাইরে রাজনীতি করা কঠিন। ওইসব দলের প্রার্থীদের টাকার কাছে নির্বাচনের সময় সবাই বিক্রি হয়ে যায়।"