খরুচে কেন্দ্র ধাপে ধাপে কমিয়ে, নবায়নযোগ্য উৎস বাড়িয়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে চায় সরকার

বিদ্যুৎ খাতে ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির আর্থিক চাপ মোকাবিলায় অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে পুরনো ও কম দক্ষ ভাড়াভিত্তিক ও স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ ও সিস্টেম লস কমানোর সুপারিশ করেছে।
খরচ নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ক্যাপাসিটি চার্জের খরচ কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। এজন্য এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা নিয়মিত পর্যালোচনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল জ্বালানি উৎসকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই সুপারিশগুলো আসন্ন বাজেট আলোচনার অংশ হিসেবে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য ৩০ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি বাদ দিয়ে ১৩ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করেছে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর শুল্ক নির্ধারণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি। পাশাপাশি, মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অর্জনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই অগ্রগতি এখনো সন্তোষজনক নয়। ব্যয়বহুল ও জ্বালানি-নিবিড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
নিরীক্ষার অধীনে আইপিপি চুক্তিগুলো, আইনি ঝুঁকি
এছাড়া, বিদ্যুতের চাহিদা ও রিজার্ভ মার্জিন (অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা) যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় কমাতে জ্বালানি মিশ্রণ বৈচিত্র্যময় করার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জ্বালানি টাস্কফোর্সের সদস্য জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভর্তুকি কমানো বলা যতটা সহজ, বাস্তবে তা করা কঠিন।
তিনি বলেন, 'তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হ্রাসে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করেছে এবং লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে—এমন কিছু আইপিপি প্রকল্পের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'আইপিপিগুলোর সঙ্গে আলোচনা "নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো মানি" ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।'
তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, অনেক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে বিরোধ দেখা দিলে তা সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সালিসি কেন্দ্রে নিষ্পত্তি করতে হয়। তাই একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করা হলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ গুনতে হতে পারে।
তিনি বলেন, 'তবে, যদি কোনো বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সরকার আইনি ভিত্তিতে এসব চুক্তি বাতিল করতে পারে।'
ভর্তুকি বাদ দিয়ে বাজেটে ৫৫ শতাংশ বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব
বিগত কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও সরকার গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, যার একটি অংশ বিশেষ বন্ড থেকে এসেছে। চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
সরকার আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির আওতায় ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গ্রিড দক্ষতায় চ্যালেঞ্জ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং সিস্টেম লস কমানো আগামী বছরগুলোতে সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২ অর্থবছরে ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লসসহ মোট সিস্টেম লস ছিল ১৪.৬ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে কমে ১০.৩ শতাংশে নেমেছে। তবে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমলেও ট্রান্সমিশন লস ২.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.১ শতাংশে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে সিস্টেম লস ১০.৮৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
এছাড়া, সীমিত গ্যাস সরবরাহের কারণে অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চমূল্যের জ্বালানির ওপর নির্ভর করছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া না হলে এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গড় বাল্ক উৎপাদন খরচ ছিল ৬.৬১ টাকা, যেখানে বাল্ক ট্যারিফ ছিল ৫.১৩ টাকা। ফলে প্রতি ইউনিটে ১.৪৮ টাকা লোকসান হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এই লোকসান আরও বেড়েছে; গড় উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১২.৩১ টাকায় উন্নীত হয়েছে, অথচ বাল্ক ট্যারিফ ৭.০৪ টাকা অপরিবর্তিত থাকায় প্রতি ইউনিটে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫.২৭ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে বিপুল বিনিয়োগ করা হলেও বিদ্যুতের চাহিদা প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা ও সর্বোচ্চ চাহিদার মধ্যে ব্যবধান আরও বেড়েছে।
গত অর্থবছরের শেষে রিজার্ভ মার্জিন, ক্যাপাসিটি ও সর্বোচ্চ চাহিদার মধ্যে পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট। বার্ষিক চাহিদা বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হলেও প্রকৃত প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে।
আদর্শ রিজার্ভ মার্জিন ২০ শতাংশ হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে এটি প্রায় ৪১ শতাংশ, যা বিনিয়োগের সুযোগ ব্যয় বাড়িয়ে তুলছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ১,২০০ মেগাওয়াট ইউনিট ২০২৫ সালের মধ্যে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপ
ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকার প্রতি তিন মাস অন্তর বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের পরিকল্পনা করেছিল। তবে, আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের নিচে নামলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য একটি চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যেখানে ইউনিটপ্রতি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ টাকা।
উৎপাদন ব্যয় কমাতে অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি গ্যাস ও তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শুল্ক পুনর্নির্ধারণের কাজ চলছে। পাশাপাশি, স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইপিপি) জন্য ক্যাপাসিটি চার্জসহ শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনার লক্ষ্যে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।