বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হলে কয়লার মূল্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে আদানি

ভারতের আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, তারা তাদের বিদ্যুৎ রপ্তানির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়লার বিতর্কিত মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে প্রস্তুত—তবে তার আগে বাংলাদেশকে বকেয়া বিল পরিশোধ করতে হবে।
সোমবার (২৩ জুন) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল বৈঠকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এবিষয়ে অবহিত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, "আদানির সঙ্গে বকেয়া বিল নিয়ে আমাদের সমস্যা রয়েছে। এবিষয়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। আদানি দাবি করছে, তাদের ৯০ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে, যদিও আমাদের হিসাব অনুযায়ী এই অংক কম। এই ব্যবধান নিয়েই মূল বিরোধ।"
তিনি জানান, আদানির দাবিকৃত বকেয়ার অংকের মধ্যে দেরিতে পরিশোধের জন্য আরোপিত জরিমানারও একটি অংশ রয়েছে, যা এখনো আলোচনাধীন। "আমরা এটি সমাধানের চেষ্টা করছি এবং আশা করছি, এক মাসের মধ্যে আদানির পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হবে। এরপরই মূল বিষয়গুলোতে অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে," বলেন সচিব।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানান, আদানির সঙ্গে আলোচনায় পাওনা পরিশোধ ছাড়াও— বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে কয়লার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। "আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করছি আদানির পাওনা পরিশোধের জন্য। আশা করছি এই সপ্তাহেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে পারব," তিনি বলেন।
বিপিডিবি চেয়ারম্যান আরও বলেন, আদানির ব্যবহৃত কয়লার মূল্য নির্ধারণের ফর্মুলা নিয়ে—বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়ানোর জন্য যেটি নিয়ে এরমধ্যেই ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। "আদানির কর্মকর্তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, তারা তাদের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করবে, এবং একটি সমাধান খুঁজে বের করতে আমাদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।"
দীর্ঘমেয়াদী একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। তবে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা রয়েছে। আদানি যে মূল্য কাঠামো অনুসরণ করছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীল সূচকের ওপরের অতিরিক্ত নির্ভরতা আছে, আবার পরিবহন ব্যয়ও অনেক বেশি ধরা হয়েছে; কারণ আদানি তুলনামূলক দূরবর্তী সরবরাহকারী দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করছে, যেখানে কাছাকাছি বাজার থেকেও আমদানি করা যেত।
বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে অসঙ্গতি চিহ্নিত করেছে; যেকারণে পায়রার মতো কয়লাভিত্তিক অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির বিদ্যুতের দামও বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আদানি কয়লার এই মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। তারা আরও বলেছে, বিপিডিবি দ্রুত বকেয়া পরিশোধ করলে—তারা ৫ কোটি ডলারের লেট পেনাল্টি মওকুফ করবে।"
তবে, বিষয়টি এত সহজ নয়। বিপিডিবি'র তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত আদানির কাছে বাংলাদেশের মোট বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ কোটি ডলার। যদিও আদানির দাবি, প্রকৃত বকেয়ার পরিমাণ ৯০ কোটি ডলার— এই ব্যবধানের জন্যও কয়লার উচ্চমূল্যের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
মূলত আদানির বিদ্যুৎমূল্য নির্ধারণের ফর্মুলার কারণেই এ বিরাট ব্যবধান তৈরি হয়েছে, যা সমালোচকদের মতে ভারতীয় এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকেই অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ১৪.৮৭ টাকা, যা পটুয়াখালীর পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১১.৮৩ টাকা ইউনিট মূল্যের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত একটি কারিগরি কমিটি ইতোমধ্যেই আদানির সঙ্গে করা ওই বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মূল্য নির্ধারণ শর্তকে ত্রুটিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। ওই চুক্তিতে কয়লার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু আন্তর্জাতিক সূচকের (গ্লোবাল ইনডেক্স) সাথে মিলিয়ে, কিন্তু আদানি এসব সূচক থেকে বিচ্যুতি ঘটায় এবং অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডিসকাউন্টও প্রয়োগ করে না।
এর পাশাপাশি, আদানি তুলনামূলক দূরের দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করছে, যার ফলে অপ্রয়োজনীয়ভাবে পরিবহন ব্যয় (ফ্রেইট চার্জ) বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আদানি কাছাকাছি সরবরাহকারী দেশ যেমন চীন থেকে কয়লা আমদানি করত, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চূড়ান্ত খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হতো।
"দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে অস্থির আন্তর্জাতিক সূচকের ওপর নির্ভর করা—বিদ্যুতের ট্যারিফকে অনির্দেশ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে," বলেন বিপিডিবি'র এক কর্মকর্তা।
আগে কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে আদানির বিদ্যুৎ এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সবচেয়ে ব্যয়বহুল উৎসে পরিণত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দ্রুত সমাধান না হলে তা কূটনৈতিক কিংবা আইনি জটিলতায় রূপ নিতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টাকে আদানির চিঠি, সরবরাহ বন্ধের হুমকি
গত ১৭ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দিয়ে আদানি পাওয়ার তাদের বকেয়া পাওনা দ্রুত পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত ক্ষমতার কারণে, বড় পরিসরে চুক্তি পুনঃআলোচনার সুযোগ না থাকায়—এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানের সম্ভাবনা অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
আদানি এনার্জি সল্যুশনস লিমিটেড (এইএসএল) ও আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল) -এর এমডি অনিল সারদানা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আদানি পাওয়ার জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিপুল বকেয়া সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন অব্যাহত রাখা এখন তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। জুন মাসের মধ্যে বকেয়া পাওনার বড় অংশ পরিশোধ না করলে—পরের মাস থেকে এই কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ধরে রাখা যাবে না। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
কোম্পানিটি আরও বলেছে, বিপিডিবি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বকেয়া রাখায় তাদের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, ফলে জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের জন্য এখন চড়া সুদের ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এপিএলের পুঁজিগত সহায়তা প্রত্যাহার করার হুমকি দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিপিডিবি নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতি মাসে ৯ থেকে ১০ কোটি ডলার পরিশোধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে, এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) মাধ্যমে এই অর্থ আদানিকে পরিশোধ করা হয়।