বিপিডিবির কাছে আদানি পাওয়ারের বকেয়া ৯০০ মিলিয়ন ডলার, জুনের মধ্যে শোধ না হলে 'বিঘ্ন ঘটবে বিদ্যুৎ সরবরাহে'

বাংলাদেশ সরকারের কাছে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের বকেয়া পাওনা বেড়েই চলেছে। গত মে মাস পর্যন্ত সরকারের কাছে আদানি পাওয়ারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এই অর্থ পায় আদানি পাওয়ার।
আদানি পাওয়ার প্রতি মাসে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে অনেকদিন ধরেই তার পুরো মূল্য বিপিডিবি পরিশোধ করতে পারে না। ফলে কিছু অর্থ বকেয়া থেকে যায়। এই বকেয়া জমতে জমতে বর্তমানে বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
গত ১৭ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে লেখা একটি চিঠিতে আদানি পাওয়ার তাদের বকেয়া দ্রুত পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিপুল বকেয়া থাকার কারণে ভারতের ঝাড়খন্ডের গড্ডায় স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন অব্যাহত রাখা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জুন মাসের মধ্যে বকেয়ার বড় অংশ পরিশোধ না হলে পরের মাস থেকে এই কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব হবে না। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
আদানি এনার্জি সলিউশনস লিমিটেড (এইএসএল) ও আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল সরদানা লিখিত চিঠিতে বলেছেন, এপিএল বিপিডিবিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে এবং বিপরীতে বিপিডিবিকে সময়মতো বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে এসেছে। কিন্তু বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের অজুহাতে বিপিডিবি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বকেয়া রেখেছে। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষে এই বকেয়ার পরিমাণ ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তাদের ওপর মারাত্মক আর্থিক চাপ এবং ঋণদাতাদের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
অনিল সরদানা আরও বলেন, বিপিডিবির পক্ষ থেকে বিলম্বিত ও অপর্যাপ্ত অর্থ পরিশোধ আদানি পাওয়ার লিমিটেডের (এপিএল) আর্থিক অবস্থাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ঋণ পরিশোধে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের জন্য এখন উচ্চ সুদের ঋণ নিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এপিএলের পুঁজিগত সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছে, কারণ বিপিডিবি বারবার অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে।
জানা গেছে, বিপিডিবি নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতি মাসে ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) মাধ্যমে এই অর্থ আদানিকে পরিশোধ করা হয়।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ডের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এজন্য আদানি পাওয়ার ও বিপিডিবির মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) রয়েছে। আদানির এই আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের উৎপাদনক্ষমতা ১৪৯৬ মেগাওয়াট। বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ১৯ জুন আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
২০২৩ সাল থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রকট হতে শুরু করে। আমদানি দায় পরিশোধে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বিনিময় হার ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। জরুরি আমদানির জন্যও ডলার পেতে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ঋণের শর্ত হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ধরে রাখার শর্ত দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিপিডিবি আদানির পাওনা পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়। ফলে আদানির কাছে বকেয়া বাড়তে থাকে।
উল্লেখ, বিপিডিবি আদানির কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদ্যুৎ কিনে সেটি বিক্রি করে স্থানীয় মুদ্রা টাকায়। সংস্থাটির নিজস্ব কোনো বৈদেশিক মুদ্রার আয় নেই। তাই বৈদেশিক মুদ্রার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়।