আদানির বিদ্যুৎ বন্ধের হুমকিতে কতটা ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ?
বর্তমান চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের আদানি গ্রুপ বকেয়া বিলের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেগুলোর দ্রুত উৎপাদন বাড়ানো মোটেও সহজ নয়।
ভারতের এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১,৬০০ মেগাওয়াটের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে গড়ে ৯৩২.৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) পাঠানো একটি চিঠিতে দিয়ে বলেছে, ১০ নভেম্বরের মধ্যে ৪৯৬ মিলিয়ন ডলারের বকেয়া বিল পরিশোধ করা না হলে ১১ নভেম্বর (আগামীকাল) থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ না করা হলেও বাংলাদেশকে মাসিক ক্যাপাসিটি পেমেন্ট—স্থায়ী খরচ, যেমন লোন সার্ভিসিং, কর্মীদের বেতন ও অবচয়—অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। বিপিডিবি বর্তমানে প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২৫ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে।
কাগজে-কলমে উদ্বৃত্ত, বাস্তবে ঘাটতি
ক্যাপটিভ উৎসসহ বাংলাদেশের মোট স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার ৪৭৬ মেগাওয়াট, যা দেশের সর্বোচ্চ চাহিদার (প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট) প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে এই আপাত উদ্বৃত্ত সক্ষমতার একটি বড় অংশই অলস পড়ে থাকে।
বিপিডিবির ২ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, এসএস পাওয়ার বাঁশখালী কেন্দ্রটি তার ১,৩২০ মেগাওয়াট স্থাপিত সক্ষমতার বিপরীতে দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় মাত্র ৫৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছে। একইভাবে ১,২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী কেন্দ্র ৬৫০ মেগাওয়াট, ১,৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ১,০৬০ মেগাওয়াট ও ১,৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ১,০৯২ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধুমাত্র এসএস পাওয়ার ও মাতারবাড়ী কেন্দ্র দুটিকে পূর্ণ সক্ষমতায় চালালেই আদানির সরবরাহ বন্ধের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
সরবরাহ বন্ধ হলে প্রভাব কতটা তীব্র হবে?
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বিশ্লেষণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা, প্রকৃত দেশীয় উৎপাদন ও আদানি থেকে গড় আমদানির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খতিয়ে দেখা হয়েছে, এই সরবরাহ বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়িয়ে আদানির সরবরাহ বন্ধের হুমকি মোকাবিলা করতে পারে বাংলাদেশ। তবে অর্থায়ন সংকটের কারণে সীমিত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রি-গ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা ও কয়লা আমদানিতে চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটি করা বেশ কঠিন।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়ার প্রায় অর্ধেক অর্থ নিয়ে বিপিডিবির নিজস্ব হিসাবেও কোনো বিতর্ক নেই। তাই বিপিডিবি এই অর্থ পরিশোধ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে পারে।
আদানির সরবরাহ বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশ অতিরিক্ত জ্বালানি আমদানি করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না পেয়েও যেহেতু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পরিশোধ করতে হবে, তাই সব মিলিয়ে বিদ্যুতের ভর্তুকি আরও বেড়ে যাবে।
২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাবেক বিশেষ সহকারী (বিদ্যুৎ ও জ্বালানি) এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, এলএনজি ও কয়লা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে আদানির সরবরাহ বন্ধের ঘাটতি বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে।
তিনি বলেন, 'অনেক বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কম সক্ষমতায় চলছে। পর্যাপ্ত কয়লা আমদানি করা গেলে আমরা সহজেই উৎপাদন বাড়াতে পারব।'
বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলামও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, 'জ্বালানি সংকটের কারণে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক উৎপাদনের বিশাল একটি অংশ হয় আংশিকভাবে চলছে অথবা অলস বসে আছে। এই কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়িয়ে আমরা বাড়তি ১,৫০০ থেকে ২,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি—যা এই ধাক্কা সামলানোর জন্য যথেষ্ট।'
বিপিডিবির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের মোট স্থাপিত বিদ্যুৎ সক্ষমতার মধ্যে ১২ হাজার ৩৮৪ মেগাওয়াট আসে (৩৯.৩ শতাংশ) প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি থেকে, ৭ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট আসে (২২.৮ শতাংশ) কয়লা থেকে, ৫ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট (১৮.৭ শতাংশ) ফার্নেস অয়েল থেকে, ১ হাজার ২৭২ মেগাওয়াট (৪ শতাংশ) ডিজেল থেকে, ২৩০ মেগাওয়াট (০.৭ শতাংশ) জলবিদ্যুৎ থেকে ও ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট (৩.৯ শতাংশ) আসে নবায়নযোগ্য—মূলত সৌর—উৎস থেকে।
মোট সক্ষমতার বৃহত্তম অংশ হলেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাধারণত দিনে মাত্র ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করে। জহুরুল বলেন, 'এলএনজির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আরও কয়েকটি এলএনজি কার্গো আমদানি করে আমরা উৎপাদন বাড়াতে পারি।'
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম উৎপাদনে
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ব্যবহৃত হচ্ছে। বিপিডিবির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তথ্যে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ৭২ শতাংশ প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর (পিএলএফ), রামপাল ৪২ শতাংশ, বড়পুকুরিয়া ৩৬ শতাংশ ও এসএস পাওয়ার বাঁশখালী ৩৪ শতাংশ পিএলএফে পরিচালিত হয়েছে।
এর অর্থ হলো, রক্ষণাবেক্ষণজনিত সমস্যা, আমদানি বিলম্ব ও অর্থ পরিশোধের জটিলতার কারণে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি অব্যবহৃত ছিল। তবে ২০২৫ সালের শেষের দিকে বকেয়া জ্বালানি বিল পরিশোধ করার পর রামপাল ও বাঁশখালীর পিএলএফ ৭৫ শতাংশের ওপরে উন্নীত হয়েছে বলে জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাক্কলন অনুসারে, রামপাল, পায়রা ও বাঁশখালীকে ৮০ শতাংশ লোডে চালালে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব—যা আদানির বর্তমান সরবরাহের দ্বিগুণেরও বেশি। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ যেকোনো সম্ভাব্য ঘাটতি মেটাতে যথেষ্টের চেয়েও বেশি।
বিদ্যুৎ খাতের জন্য বৃহত্তর শিক্ষা
আদানির এই ঘটনা একটি দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে: প্রাথমিক জ্বালানি (গ্যাস, কয়লা ও তরল জ্বালানি) নিশ্চিত না করে শুধু উদ্বৃত্ত উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল মেগাওয়াট যোগ করার প্রবণতা থেকে সরে এসে সেই মেগাওয়াটের দক্ষ ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
ম তামিম বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের জন্য যে সিস্টেম দরকার, তা গড়ে তোলার আগেই আমরা দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে ফেলেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'বিল প্রক্রিয়া নিয়ে চলমান বিরোধের জেরে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে এই তারল্য সংকটের মধ্যে বাংলাদেশকে প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে; তবে সেই চ্যালেঞ্জ সামাল দেওয়া অসম্ভব নয়।'
