শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশ নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না: অধ্যাপক সেলিম রায়হান

টাস্কফোর্স এবং শ্বেতপত্র কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেছেন, দেশের অর্থনীতির সংস্কার ও করণীয় নিয়ে শ্বেতপত্র এবং টাস্কফোর্স কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তা নিয়ে সরকারের কোথাও আলোচনা হচ্ছে বলে তিনি শুনছেন না বা জানেনও না।
তিনি বলেন, "দুই কমিটিতে ২৩ জন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ছিলেন, তারা একটি ডকুমেন্ট তৈরি করে সরকারকে দিয়েছেন। এটা নিয়ে সরকারের কাজ করার সুযোগ ছিল। মন্ত্রণালয়গুলোও সতন্ত্রভাবে সংস্কার বা রিফর্মের কাজ করতে পারতো। কিন্তু আমরা তা করতে দেখছি না।"
"হোয়াইট পেপার কমিটি কিংবা টাস্কফোর্সের দেওয়া বিষয়গুলো নিয়ে সরকারে খুব আলোচনা হচ্ছে, এমনটা মনে হচ্ছে না। কোথাওই কোনো রকম আলোচনা হচ্ছে না। এমনকি, আমরা যারা জড়িত ছিলাম, তাদেরকে ডেকেও সরকার বলতে পারতো যে আমরা বুঝতে পারছি না, কিংবা যেটা লিখেছেন সেটা ইউজলেস," ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক স্টাডি সেন্টার আয়োজিত 'আনভেইলিং দ্য ট্রুথ: দ্য স্টেট অফ বাংলাদেশ'স ইকোনমি অ্যান্ড গভর্নেন্স' শীর্ষক এক সেমিনারে অধ্যাপক সেলিম রায়হান এসব কথা বলেন।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত এই সেমিনারে তিনি শ্বেতপত্র এবং টাস্কফোর্স কমিটিতে কাজ করার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "যেকোনো সংস্কার বা রিফর্মসের ক্ষেত্রে চাহিদা বা ডিমান্ড সাইড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই দুই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দেশের অর্থনীতি সংস্কারে কিছু উদহারণ তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে বলে দেখছি না।"
গত বছরের ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পরিবর্তন হওয়ার পর অর্থনীতির সংস্কার ও আগামী দুই-তিন বছরে করণীয় নির্ধারণে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠন করা হয়।
গত সেপ্টেম্বরে কাজ শুরুর পর ১ ডিসেম্বর হোয়াইট পেপার বা শ্বেতপত্র কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সরকার গঠিত টাস্কফোর্সও আলাদা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
'এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পেছানোর সম্ভাবনা দেখছি'
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, "এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ হয়তো বলবেন, এখন হওয়া উচিত না; আবার কেউ হয়তো বলবেন, হওয়া উচিত। জিডিপির যে ইনফ্লাটেড গ্রোথ, সেটাকে এডজাস্ট করলেও পার ক্যাপিটাল ইনকামের যে থ্রেসহোল্ড, সেটা মেইনটেইন হবে।"
তিনি বলেন, "দেশের অর্থনীতি বিচার বিশ্লেষণ করে এই গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আরও কিছুদিন সময় চাওয়া লাগতে পারে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে আবার সমস্যাও তৈরি করতে পারে। আমি পেছানোর সম্ভাবনা দেখছি।"
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সে আমরা যা লিখেছি, সবাই একমত হয়ে লিখেছি, এটা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের দুইজন অর্থনীতিবিদ এক হওয়া কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ।"
"আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ডেফার করার কোনো কারণ নেই। আমাদের এক সময় গ্র্যাজুয়েশন করতে হবে। এই মুহূর্তে করলে আমাদের আগামী বছর করা উচিত। কারণ ইতোমধ্যে কিছু প্রস্তুতি তো নেওয়া হয়েছে। আর পেছানো হলে তিনবছর পর আবার ঘুরেফিরে একই জায়গা আসবো, পিছিয়ে যাব।"
"কিন্তু বাস্তবতা হলো–কিছু বিষয় তৈরি হবে, যাতে গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে বা পরিবর্তনের বিষয় আসতে পারে," যোগ করেন তিনি।
ভেস্টেড বা ইন্টারেস্ট গ্রুপের কারণে অনেক সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় না, তবে এই গ্রুপ রেখে সংস্কার করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে সেলিম রায়হান বলেন, "সংস্কার করা সম্ভব। কোথাও ছোট উদ্যোগ কিংবা কোথাও বড় উদ্যোগ নিতে হবে। একটা অন্তত উদহারণ সেট করার প্রয়োজন ছিল।"
'আইএমএফের টাকা প্রয়োজন নেই'—ঝুঁকি দেখছেন সেলিম রায়হান
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এক বক্তব্য উদ্ধৃত করে সেলিম রায়হান বলেন, "গভর্নর বলছেন, এখন আইএমএফ'র টাকার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে বড় ধরনের ঝুঁকি দেখছি। রপ্তানি কিংবা রেমিটেন্স থেকে হয়তো কিছু টাকা চলে এসেছে, এই জন্যই হয়তো তিনি এই কথা বলেছেন। কিন্তু বিপদটা হচ্ছে সংস্কারের আশ্বাসটা কি ঠিক থাকছে?"
তিনি বলেন, "বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি যখন বিভিন্ন দেশে ঋণের প্যাকেজ নিয়ে যায়, তখন নেগোসিশেনরে সময় কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমন শর্ত দিয়েছে। এখন গভর্নরের কথায় ভয়টা হচ্ছে, আইএমএফের টাকা দরকার নেই, বলার মধ্য দিয়ে সংস্কারককে বাদ দিচ্ছি কিনা।"
শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, "শ্রীলঙ্কার টার্নঅ্যারাউন্ডটা খুব ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আমাদের বিপদটা হচ্ছে, আমরা ইতোমধ্যে একটা ট্রাপে পড়ে গেছি। এটা যতটা আতঙ্কের বিষয়, তার চেয়ে বড় আতঙ্ক হচ্ছে এটা থেকে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়।"
"শ্রীলঙ্কার গভর্নর কোনো রাজনৈতিক চাপ ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন, যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মতো পরিস্থিতিতেও চলে এসেছে দেশটি। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছে। পাশাপাশি তাদের হিউম্যান ক্যাপিটালও অনেক ভালো। তারা অনেক বছর আগেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করেছে। এক সময় অনেক বড় বিনিয়োগ করার কারণে এখন তেমন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়নি। একটা দেশের প্রতিষ্ঠান কীভাবে সংকটেরর সময় পার্থক্য গড়ে দেয়, তার উদহারণ শ্রীলঙ্কা। তবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, "এই সরকারের প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে তারা বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে—যেখানে সংস্কারের আইডিয়া এসেছে। ১৯৯১ সালে তত্ব্বাধায়ক সরকারের সময়ও অনেক সংস্কার কমিশন হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো বস্তবায়ন হয়নি।"
"চারদশক আগেও দেওয়া সুপারিশ রিফর্ম হয়নি। দেশের ভেস্টেড শক্তিশালী গ্রুপের কারণে সেটা হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বও সেটা করেনি। অনেক রাজনৈতিক দলও ওই গ্রুপের বেনেফিসিয়ারি। রাজনৈতিক দলের আর্থিক উৎসও স্বচ্ছ না। তাদের খরচ জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত," যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।