পাল্টা শুল্ক কমায় স্বস্তি, তবে রপ্তানি ভবিষ্যৎ এখনও নির্ভর করছে চীনের ওপর: সেলিম রায়হান

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামানো রপ্তানি খাতের জন্য একটি স্বাগতযোগ্য অগ্রগতি।
এই হার সংশোধন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কাঠামোর একটি বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ, যা দেশটির অনেক বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর প্রযোজ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, আর পাকিস্তানের হার ২৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী, যেমন ভিয়েতনাম ও ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে শুল্কহার যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ।
এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের নতুন শুল্কহার এখন প্রধান প্রতিযোগীদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা বাণিজ্যবিচ্যুতির ঝুঁকি কমায় এবং বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের কোনো বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনাও হ্রাস করে।
তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশে একটি উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে—চীনের ওপর পাল্টা শুল্কহার এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কাঠামোয় চীনের মূখ্য ভূমিকা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতার কারণে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের জন্য কী ধরনের শুল্ক নির্ধারণ করে, সেটি আগামী দিনের বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
যদি চীনের ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রপ্তানিকারক দেশগুলোর পক্ষে চাহিদা স্থানান্তর ঘটতে পারে। অন্যদিকে, যদি চীন স্বল্প শুল্ক সুবিধা পায়, তাহলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। ফলে চীনের শুল্ক নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, বাণিজ্যের গতিপ্রবাহ আগামীতে কীভাবে পুনর্গঠিত হবে।
যদিও এই শুল্ক হ্রাস স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি এনেছে, তবে এটি একটি প্রশ্নও উত্থাপন করে—বাংলাদেশ এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিয়েছে? কিছু প্রতিশ্রুতি—যেমন গম, তুলা ও বিমান আমদানির বিষয়টি জনসমক্ষে এসেছে। তবে অনুমান করা যায়, আরও কিছু সংবেদনশীল প্রতিশ্রুতি গোপনীয়তা চুক্তির আওতায় দেওয়া হয়েছে, যা নিকট ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে না। এটি বাংলাদেশের বাণিজ্য কূটনীতিতে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে।
এই ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি তুলে ধরে যে, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য কাঠামোতে আরও বেশি স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা তৈরি করা জরুরি। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি কৌশলগত অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমত, বাংলাদেশকে রপ্তানি পণ্যের পরিসর বাড়াতে এবং ঐতিহ্যবাহী বাজারের বাইরে নতুন বাজারে প্রবেশের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। খুব সীমিত পণ্য ও গন্তব্যের ওপর নির্ভরশীলতা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিনির্ভরতা, অর্থনীতিকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং টেকসই বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য দেশে বাণিজ্য, কর ও বিনিয়োগ নীতিতে অর্থবহ সংস্কার প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের উন্নয়ন বাংলাদেশকে একটি আরও স্থিতিশীল ও আকর্ষণীয় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে লক্ষ্যভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনুসন্ধান করতে হবে। এসব চুক্তি ভবিষ্যতের সংরক্ষণবাদী চাপে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে এবং বিকল্প রপ্তানি প্রবাহ তৈরিতে সহায়ক হবে।
সুতরাং, পাল্টা শুল্ক হ্রাস একটি উৎসাহব্যঞ্জক অগ্রগতি হলেও আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই। বরং এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা, যাতে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল গড়ে তোলা যায়।
- ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক
- [লেখাটি ড. সেলিম রায়হানের ফেসবুক থেকে নিয়ে অনূদিত]