পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে ১১ অগ্রাধিকার মামলা নিয়ে এগোবে সরকার

সরকার পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ ১১ ব্যক্তি ও শিল্প সংশ্লিষ্ট মামলা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হলো চলতি বছরের মধ্যেই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্তত অর্ধেক মামলা নিষ্পত্তি করা।
এ মামলাগুলোর আওতায় বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেওয়া হবে। পাশাপাশি, পাচারকৃত সম্পদের বিক্রয় বা হস্তান্তরের ওপর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনাও রয়েছে। এছাড়া, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালনার জন্য সরকার একটি 'অ্যাসেট রিকভারি এজেন্সি' গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
সোমবার (১০ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় 'পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধার, গৃহীত পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সভার ফলাফল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অর্থ ফেরত আসার পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য ফি হিসেবে একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ করা হবে।
তিনি আরও জানান, 'অর্থ প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে এক সপ্তাহের মধ্যে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হবে।'
সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াতি, দুর্নীতি ও সরকারি চুক্তিতে অনিয়মের মাধ্যমে দেশ থেকে ৭৫ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
তারা আরও বলেন, এ অর্থ প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ বিভিন্ন অফশোর কেন্দ্রে পাচার করা হয়েছে।
১১টি অগ্রাধিকার মামলার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অন্যান্য সংস্থাগুলোও মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংক পাচারকৃত সম্পদ কার্যকরভাবে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মূল পাচার গন্তব্যস্থলগুলোর সরকারি সংস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
তবে, তদন্তাধীন অন্যান্য ব্যক্তি বা শিল্প গোষ্ঠীর নাম আইনি জটিলতা এড়ানোর স্বার্থে প্রকাশ করা হয়নি বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে হাসিনা প্রশাসনের সময়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এচ মনসুর এর আগে বলেছিলেন, একই সময়ে শুধু ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমেই ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ
বিদেশে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আগামী ১৭ মার্চ যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তিনি যুক্তরাজ্যে পাচারকৃত তহবিল পুনরুদ্ধারে সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ত অবৈধ সম্পদের বিক্রয় বা স্থানান্তর নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানাবেন।
গভর্নর প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন, তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে শীর্ষ বাংলাদেশি পাচারকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।
এছাড়া, ১৯ মার্চ তিনি আন্তর্জাতিক আইন সংস্থা, তদন্ত সংস্থা ও লিটিগেশন ফান্ডার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধার বিষয়ে একটি সম্মেলন করবেন। তিনি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর, ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি এবং বর্তমান ও সাবেক বিচার সচিবদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
আগামী মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন সমন্বয় কেন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার ও বিশ্বব্যাংকের স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ-এর সহযোগিতায় লন্ডনে 'বাংলাদেশ অ্যাসেট রিকভারি কনফারেন্স' আয়োজন করবে।
এ সম্মেলনে অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং টাস্কফোর্স-এর সদস্যসহ অন্যান্য অংশীদারদের একত্রিত করা হবে এবং অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা হবে।
যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক সংস্থা
সরকার ২০০ কোটি টাকার বেশি পাচার হওয়া তহবিল পুনরুদ্ধারে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক আইন সংস্থাগুলোকে নিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
১১টি অগ্রাধিকার মামলায় পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাংকের অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ, ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার, মার্কিন বিচার বিভাগ এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি-এর সহায়তা চাওয়া হচ্ছে।
এ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ শনাক্ত ও তদন্ত করা হবে।
পাশাপাশি, বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়ে অবৈধ সম্পদ স্থগিত, জব্দ ও বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদ ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক দূত আগামী এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের অনাবাসী রাষ্ট্রদূত ডেরেক লোহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করছেন। এর মূল লক্ষ্য—সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করা।
এ উদ্যোগ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইতোমধ্যে ৩০টিরও বেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, তদন্ত সংস্থা ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে ১৫০টির বেশি বৈঠক করেছে।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততার জন্য শর্তাবলী (টার্মস অব রেফারেন্স) চূড়ান্ত করা হবে মার্চের শেষ নাগাদ। এরপর এপ্রিলের শেষ দিকে বা মে মাসের শুরুতে এসব সংস্থা নিয়োগ করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রোসাটমের দুর্নীতির তদন্তে সহায়তা করবে মালয়েশিয়া
হাসিনা, তার পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তদন্তে নিয়োজিত একটি যৌথ দল মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকে রাশিয়ার 'স্লাশ ফান্ড' জমার প্রমাণ পেয়েছে।
হাসিনার বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঠিকাদার, রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের কাছ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তদন্তকারীরা সন্দেহ করছেন, এ অর্থ মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকে জমা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, মালয়েশিয়া সরকার এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্সের পরামর্শক চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়া সফর করে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কমিশন তদন্তে সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এছাড়া, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানো হবে।
১১ মামলায় ৮৪ জন অভিযুক্ত
১১টি অগ্রাধিকার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিও (বেনিফিশিয়াল ওনারশিপ) অ্যাকাউন্টে থাকা ১৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার শেয়ার স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া, যৌথ তদন্ত দল অভিযুক্তদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ৮৭২ কোটি টাকা স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এক হাজার ৩৭৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছে, যার মোট অর্থমূল্য ৬১৪ বিলিয়ন টাকা। পাশাপাশি, ১৮৮টি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১০টি মামলার গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, যার মধ্যে চারটি তদন্তাধীন। মামলাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ৮৪ জনের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
১১টি অগ্রাধিকার মামলার মধ্যে শেখ হাসিনা, তার পরিবার এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
এ মামলাগুলোর আওতায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৮১৭ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে এক হাজার ২৪৬ লাখ ডলার, ৩৭.৯৭ লাখ পাউন্ড এবং ১১৭ লাখ ইউরো মূল্যের সম্পদও জব্দ করেছে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউ জানিয়েছে, হাসিনা, তার পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৬৩৫.১৪ কোটি টাকা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধীনে থাকা ১.৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৬০ কাঠার একটি প্লটসহ মোট আটটি প্লট এবং আরও ৮.৮৫ কোটি টাকা মূল্যের জমি ব্লক করা হয়েছে।
তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে হাসিনা, তার পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এছাড়া, মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকে রাশিয়ার 'স্লাশ ফান্ড'ও শনাক্ত করা হয়েছে।
হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার ছয়টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলার কারণে পরিবারের সাত সদস্যের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে ৫৭৮টি সম্পত্তি
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১২৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তার মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া, তার নামে থাকা ১৫.০৬ কোটি টাকা নগদ জব্দ করা হয়েছে।
এছাড়া, ২০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি সম্পত্তিও জব্দ করা হয়েছে। সরকার আরও দুটি ফ্ল্যাট এবং ৩১ হাজার ৫৯৪ শতাংশ জমি জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে।
এদিকে, তার ১০২.৮৫ কোটি টাকার শেয়ারও জব্দ করা হয়েছে। বিএফআইইউ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে সাতটি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি সম্পত্তি জব্দ করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে।