বাংলাদেশের পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধার প্রচেষ্টা যেভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে
গত ১৫ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া বিলিয়ন বিলিয় ডলার উদ্ধারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষ কোনো সাফল্য পায়নি। এর মধ্যে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের বেশিরভাগই এ বিষয়ে সহযোগিতা সীমিত রেখেছে। কিছু দেশ আবার আনুষ্ঠানিক আইনি সহায়তার বদলে 'বিকল্প পন্থা' গ্রহণের জন্য ঢাকাকে পরামর্শও দিয়েছে।
গত ১৭ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটির সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ১৯টি পারস্পরিক আইনি সহায়তা অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টস রিকুয়েস্টস বা এমএলএআর) পাঠিয়েছে।
এর মধ্যে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেসব দেশ কেবল পারস্পরিক আইনি সহায়তা অনুরোধের ওপর নির্ভর না করে অবৈধ আর্থিক প্রবাহ শনাক্তকারী আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে।
ওয়ার্কিং কমিটি প্রধান ১০টি গন্তব্য চিহ্নিত করেছে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে যেখানে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো হলো- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও হংকং।
এর মধ্যে মালয়েশিয়া, হংকং ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের সাথে পারস্পরিক আইনি সহায়তা অনুরোধের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড বিকল্প পন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে।
কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড এ বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই চার দেশ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের অবস্থান অনুসরণ করতে পারে।
বাংলাদেশের বিদেশি মিশনগুলো এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে, যাতে এ বিষয়ে দ্রুত সাড়া পাওয়া যায়।
ওই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার সাথে পারস্পরিক আইন সহায়তা অনুরোধ চুক্তি স্বাক্ষর প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে এই চুক্তির খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আর হংকংয়ের সাথে চুক্তির খসড়া প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। চুক্তিটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ভেটিং শেষে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হবে।
'অল্টারনেটিভ অ্যাপ্রোচ' বা বিকল্প পন্থা বলতে আসলে কী বোঝায়?
আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'অল্টারনেভিভ অ্যাপ্রোচ বলতে ওইসব দেশ পাচার করা অর্থ উদ্ধারের বৈশ্বিক সংস্থার মাধ্যমে চেষ্টা করার পরামর্শ দিচ্ছে। বিশেষ করে দি এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) এবং এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। নতুবা ওইসব দেশের আইন অনুযায়ী যতটা সহায়তা করা যায়, সেটি চাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।'
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ এবং পাচার করা অর্থ উদ্ধারের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স রয়েছে। টাস্ক ফোর্সের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
'পাচার হওয়া অর্থ থেকে ওইসব দেশ উপকৃত হচ্ছে'
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গত ২৬ নভেম্বর এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেছিলেন, কিছু দেশ 'অল্টারনেটিভ অ্যাপ্রোচ' অনুসরণের যে পরামর্শ দিয়েছে, তা বিষয়টি নিয়ে বিলম্ব করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। আর এর কারণ হতে পারে হয়তো বাংলাদেশ পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি এবং ওইসব দেশ পাচারকৃত অর্থ থেকে উপকৃত হচ্ছে।
তিনি এও জানান, পাচার হওয়ার অর্থ ফেরত আনা অত্যন্ত জটিল। কারণ, এসব অর্থ বিদেশে প্রায়শই 'বৈধ' হিসেবেই গণ্য হয়। এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত, আইনি এবং ফরেনসিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন এ কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাচার করা এসব অর্থের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাজ্য। লন্ডনের আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট বাজারকে লক্ষ্য করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে যুক্তরাজ্যে তিন শতাধিক সম্পত্তি রয়েছে। ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা ন্যাশানল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ সম্পত্তি জব্দ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
ব্যাংকখাতে সীমাহীন লুটপাটে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের নাম উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুমান- গ্রুপটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, এমনকি তার চেয়েও বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে গ্রুপটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব অভিযোগ 'সম্পূর্ণ অসত্য'।
চলতি বছরের আগস্টে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে গড়ে তোলা ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচটি দেশের সাতটি শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানায় এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
এছাড়া ৯টি দেশে ৩৫২টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো টাকার বিনিময়ে কিছু বাংলাদেশি অর্জন করেছে।
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে (ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস) প্রকাশিত পানামা পেপার্সেও উঠে এসেছে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সরকারের অগ্রাধিকার
গত ১৭ নভেম্বরের সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে সরকার ১১টি কেসকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। এই ১১টি কেসের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৭৩টি ও সিআইডি ১৭টি মামলা করেছে। এর মধ্যে দুদকের ৯টি ও সিআইডির ১৭টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় ৬০০- এর বেশি মানুষের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
ওই সভায় বাংলাদেশ বিএফআইইউয়ের প্রতিনিধি জানান, পাচার করা অর্থ উদ্ধারে গঠিত টাস্ক ফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এইচবিএম ইকবাল, তার পরিবার ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মানি লন্ডারিং অপরাধ অনুসন্ধানে দুদক, এনবিআর ও সিআইডির সমন্বয়ে যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দল (জেআইটি) গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় জেমকন গ্রুপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানি লন্ডারিং কেসটি অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এইচবিএম ইকবাল সংশ্লিষ্ট কেসটি ১১টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কেসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা কঠিন ও জটিল কাজ বলে উল্লেখ করেছেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। গত ২৪ নভেম্বর হবিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে দুদকের জেলা সমন্বিত কার্যালয় আয়োজিত গণশুনানি শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'পাচার করা অর্থ ফেরত আনা অত্যন্ত কঠিন। এ বিষয়ে দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করছে। তবু পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের অগ্রগতি এখনও সন্তোষজনক নয়।'
এদিকে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি দি এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) চতুর্থ পর্বের মিউচুয়াল এভাল্যুয়েশন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এপিজি ২০২৭-২৮ সালে বাংলাদেশের চতুর্থ মূল্যায়ন করবে।
এই মূল্যায়নে বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় ঝুঁকি, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত ঝুঁকি পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনতে ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক)কে প্রধান করে ৮ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটিতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, র্যাব, এনএসআই, ডিজিএফআই, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট ও বিএফআইইউর প্রতিনিধি রয়েছেন।
