মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের এখনো কেন বেতন-বোনাস দেওয়া হচ্ছে, প্রশ্ন আইএমএফ’র
বাংলাদেশের প্রায় দুই ডজন ব্যাংকের বিরুদ্ধে 'সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ' গ্রহণ না করার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি প্রশ্ন তুলেছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় যখন ব্যাংকগুলোতে গুরুতর মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তখনও কেন এসব ব্যাংককে অবসায়নের আওতায় আনা হচ্ছে না এবং কেন এখনো এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন ও বোনাস পাচ্ছেন।
রোববার (২ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর সম্পদ শ্রেণিবিন্যাস ও প্রভিশনিং, ঋণ ঝুঁকি (ক্রেডিট রিস্ক), এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিল নীতিমালা (রেগুলেটরি ফরবিয়ারেন্স) নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা জানতে চান, 'যেসব ব্যাংক খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতিতে গভীর সংকটে রয়েছে, তাদের অবসায়ন করা হচ্ছে না কেন? এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেন বছরের পর বছর বেতন-বোনাস দেওয়া হচ্ছে?'
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে ব্যাংক অবসায়নের দৃষ্টান্ত তেমন নেই। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূতকরণের (মার্জার) প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোর জন্য মূলধন পুনর্গঠন (ক্যাপিটল রেস্টোরেশন) পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে তারা ধীরে ধীরে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারে।
তবে আইএমএফ প্রতিনিধিরা এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট হননি। তারা প্রশ্ন তোলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই পুনর্গঠন পরিকল্পনা কতটা কার্যকর? তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা দেশের আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব ব্যাংকের পুনর্গঠন বা অবসায়নের জন্য এখনই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
মূলধন ঘাটতি বেড়েই চলছে
চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা তিন মাস আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মূলধন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্চ প্রান্তিকে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মূলধন ঘাটতিতে থাকা ২৪টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ২টি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ১৮টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
এক্সচেঞ্জ মার্কেট এখনো পুরোপুরি ফ্রি ফ্লোটিং নয়: আইএমএফ
রোববার বিকেল ৫টার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুরের সঙ্গে আইএমএফ দলের বৈঠক হয়। বৈঠকে কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত একজন নির্বাহী পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–কে জানান, আইএমএফ প্রতিনিধি দল মন্তব্য করেছে যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার এখনো পুরোপুরি ফ্রি ফ্লোটিং অবস্থায় যায়নি।
জবাবে গভর্নর বলেন, "আমরা সম্পূর্ণ ফ্রি ফ্লোটিং অবস্থায় আছি, বাজারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয় না।" তখন আইএমএফ প্রতিনিধি দল প্রশ্ন তোলে, "যদি হস্তক্ষেপ না হয়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন বাজার থেকে ডলার কিনছে?"
উত্তরে গভর্নর বলেন, "রপ্তানি ও রেমিট্যান্সনির্ভর দেশগুলো সব সময়ই বাজার থেকে ডলার কেনে।"
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, "জাপানের মতো দেশও বাজার থেকে ডলার কেনে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার রয়েছে এবং আমদানির চাহিদা কিছুটা কম। তাই বাজারে অতিরিক্ত ডলার থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা কিনে নিয়েছে।"
রিসিডিউল নীতি ও কুলিং পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, নতুন ঋণ পুনঃতফসিল (রিসিডিউল) নীতি ও কুলিং পিরিয়ড নিয়ে আইএমএফ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ অবিলম্বে পারফর্মিং লোন হিসেবে গণ্য না করে নির্দিষ্ট সময়ের একটি কুলিং পিরিয়ডে ঋণগ্রহীতার পরিশোধ আচরণ (রিপেমেন্ট বিহেভিয়র) পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বর্তমানে জারি করা সার্কুলারে কুলিং পিরিয়ডের কোনো বিধান নেই।
একজন কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের দেশে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে নীতিমালা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কঠোর। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করেই এ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, এবং আইএমএফও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছে।"
