দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত নয়, বন্ধ করা উচিত: বিটিএমএ সভাপতি

দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করার বদলে বন্ধ করাই উত্তম হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি শওকাত আজিজ রাসেল।
সোমবার (১০ আগস্ট) এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "মরে যাওয়া ব্যাংকগুলো বাঁচাতে টাকা ঢালছেন কেন? চোরদের পিছনে টাকা দিচ্ছেন কেন? ওই টাকা বরং ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের ফিরিয়ে দিন। যত পরিবর্তনই আনুন না কেন, এসব ব্যাংকের মালিকানা একই থাকবে—তারা আবারও ফিরে আসবে।"
"এই ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য ভালো ব্যাংককে কয়েকটা করে শাখা দিয়ে দিন," সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত 'অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন' শীর্ষক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
সংলাপে অংশ নেওয়া ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলারা বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণ বা সংযুক্তি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, "পাঁচটি ব্যাংক মার্জ করবেন—এ কথা বলছেন। যখন করবেন তখন বলতেন। এখন ওইসব ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এসব ব্যাংকের তৈরি পোশাক খাতের গ্রাহকরা সমস্যায় পড়ছেন।"
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, "মার্জার বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে বৈঠক ডাকা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ডেকে জানতে চাওয়া হবে তারা নিজে টিকে থাকতে পারবে কি না, অথবা মার্জারের জন্য প্রস্তুত কি না। একসঙ্গে সব ব্যাংকের মার্জার হবে না।"
"তবে সমস্যা হচ্ছে—প্রতিটি ব্যাংক আলাদা কোর ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করে, কেউ লিস্টেড কোম্পানি, আলাদা বোর্ড রয়েছে। এসব বিষয় কীভাবে সমন্বয় হবে, তা পরিষ্কার নয়। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কিছু বাস্তব কারণ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে রেগুলেটর হিসেবে পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এখন কিছুটা ফেয়ার প্লে হচ্ছে, পরিসংখ্যানভিত্তিক দুর্নীতি নেই। তবে মার্জার বিষয়ে আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার," বলেন তিনি।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মাদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, "মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু পলিসি রেটই একমাত্র সমাধান নয়, সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় উন্নতি দরকার। এখন ব্যাংক মার্জার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এতে সরকার বিনিয়োগ করবে বলা হচ্ছে। এই বিনিয়োগের অর্থ যদি রাজস্ব থেকে না এসে বাংলাদেশ ব্যাংক ইনজেক্ট করে, তাহলে এটি নতুন বিপর্যয় তৈরি করবে।"
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত এ আলোচনায় শ্রম ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি ছিলেন। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ বলেন, "রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না। সবার আগে দরকার সুশাসন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যারা দেশে বড় বিনিয়োগ করেছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, তাদের অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে না আসাই ভালো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি নেতিবাচক দিকও রয়েছে—এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।"
এ বি পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, "রাজনীতিতে অনেকেই খুব অভদ্র ভাষা ব্যবহার করছেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার হয়েও অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আমলাতন্ত্রকে যথাযথভাবে সমাধান করতে পারেনি। অর্থনীতি প্রথম অগ্রাধিকার পাবে। নির্বাচন কিভাবে হবে, বিশ্বাসযোগ্য কিভাবে হবে—সেসব ঠিক করতে হবে। ১৯৭৯ সালের মডেলে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যেভাবে সংসদ হয়েছিল, সেরকম হবে কি না, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।"
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, "শিক্ষা খাত গুরুত্ব পায়নি। নিম্নবিত্ত বা দরিদ্রদের প্রয়োজন সংস্কারের মধ্যে হারিয়ে গেছে। বৈষম্য দূর করতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। বৃত্তি ব্যবস্থায় কোটা রাখা উচিত হবে না। নীতি প্রণয়নে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।"
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য ড. এম তামীম বলেন, "গত সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। দুর্নীতি নিয়ে নানা আলোচনা হলেও কোনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বকেয়া পরিশোধ হলেও ভর্তুকি কমেনি। আগের করা চুক্তিগুলোও পর্যালোচনা হয়নি। গ্যাসের স্বল্পতা রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চাহিদা ৩৮০০ ঘনফুট, সরবরাহ হচ্ছে ২৮০০ ঘনফুট। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪ হাজার মেগাওয়াট বন্ধ আছে। কোন জ্বালানি থেকে কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তা এখনই ঠিক করা দরকার। নইলে ঝুঁকি আছে। অনেক পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র রাখা হয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি দেখানোর জন্য—এসব নিয়েও সিদ্ধান্ত দরকার। জ্বালানির ক্ষেত্রে বিকল্প উৎস কী হবে, তাও ঠিক করা যাচ্ছে না। সংস্কারের যে সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে ছিল, তা তারা কাজে লাগাতে পারেনি।"
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "আমাদের বিবেচনায় মানুষ স্বস্তি চায়, কিন্তু ৩৬৫ দিনে প্রকৃত অর্থে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দূর করতে না পারলে স্বস্তি আসবে না। দরিদ্ররা সমস্যায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়।"
তিনি আরও বলেন, "স্বস্তির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। শ্রমজীবীদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আনতে হবে। সবাইকে যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি, তবে আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়নি—সেটি পূরণ করতে হবে।"
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এসএম আমানুল্লাহ বলেন, "আমরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা হারিয়েছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ লাখ শিক্ষার্থী আছে, কিন্তু তারা আসলে পরীক্ষার্থী। দেশের উচ্চশিক্ষার ৭০ শতাংশ এখানেই, যা যৌক্তিক কি না, তা ভাবতে হবে।"
"সম্প্রতি একটি কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখি, শিক্ষার্থীরা এআই ব্যবহার করে পরীক্ষা দিচ্ছে, আর অধ্যক্ষ চা খাচ্ছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাসের সঙ্গে শিল্পখাতের কোনো সংযোগ নেই। এরপরও কেউ কিছু বলে না, কারণ এসব শিক্ষার্থী চাকরি পেলেই পাল্টানোর চিন্তা করে না। সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাণ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানে এদের চাহিদা আছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়, কিন্তু সিলেবাস প্রথম শিল্প বিপ্লবেরও নয়। কলেজে ল্যাব থাকলেও ব্যবহার হয় না, অথচ শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল নম্বর ঠিকই পায়। কলেজ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনে অরাজক পরিস্থিতি চলছে, নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হতে ৯০ বছরের ব্যক্তি বা হাজার কোটি টাকার মালিকও চেষ্টা করছেন—এটি তাদের পরিবারের গৌরব বলে মনে করছেন। শিক্ষা খাতে সংস্কার জরুরি।"
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রতিনিধি তানভীর মো. দিপু বলেন, "চাঁদা বেড়েছে, সরকারের সফলতা ৫০ শতাংশ। নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, ব্যবসায়ীরা রাতে বাসায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।"
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমীর বলেন, "অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।"
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, "আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং তাদের সময়ে অনিয়মকারী ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। গত এক বছরে সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। আগামী ছয়-সাত মাসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।