কর ফাইলে লুকানো ১,৩৩৯ বিলাসবহুল গাড়ি শনাক্ত করেছেন এনবিআরের গোয়েন্দারা

বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করছেন, এমনকি বিআরটিএ থেকে নিবন্ধনও নিয়েছেন, কিন্তু ট্যাক্স ফাইলে দেখাননি, এমন অন্তত ১,৩৩৯টি গাড়ির সন্ধান পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) -এর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। এর বাইরে আরো ৪০৯টি গাড়ির মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা কর রিটার্নই জমা দেননি।
রাজস্ব বোর্ডের সিআইসি এবং কর বিভাগের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এসব গাড়ির প্রতিটির দাম করসহ ১ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এ তালিকায় রয়েছে টয়োটা, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, জিপ, ল্যান্ড রোভার, অডি, রেঞ্জরোভার, পোরশে, জাগুয়ার, বেন্টলি, রোলস রয়েস, ক্যাডিলাক, মাসেরাতি, টেসলা, ফেরারি ও ল্যাম্বরগিনির মতো নামীদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি।
কর কর্মকর্তারা গাড়ির মালিকদের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করলেও নিশ্চিত করেছেন যে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্য, রাজনীতিবিদ এবং এর বাইরে অন্যান্য ব্যক্তিও রয়েছেন। রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এসব গাড়ির তথ্য কর রিটার্নে ঘোষণা না করায় মালিকরা কার্যত সমপরিমাণ আয় গোপন করেছেন। অবৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে এসব গাড়ি কেনা হয়েছে এমন সম্ভাবনাও প্রবল।
সিআইসি দেশে বর্তমানে এধরনের উচ্চ মূল্যের ৫,৪৮৯টি গাড়ি শনাক্ত করেছে। এরমধ্যে প্রদর্শিত গাড়ির সংখ্যা ২,৭১৯টি, এরমধ্যে ১৪৮ গাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য না হওয়ায় তাদের ফাইল পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কর ফাইলে না দেখানো ১,৩৩৯টি বিলাসবহুল গাড়ির সন্ধান পাওয়ার সত্যতা টিবিএস-কে নিশ্চিত করেছেন সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব। তিনি বলেন, "এসব গাড়ির মালিকদের কাছে ট্যাক্স-সংক্রান্ত নোটিশ সার্ভ করতে সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স অফিসগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার ট্যাক্স জোন-১৮, যার আওতায় ১২টি অপ্রদর্শিত গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে, এর একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমরা সিআইসি'র চিঠি পাওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে নোটিশ পাঠানো শুরু করেছি।"
তিনি বলেন, "বিআরটিএ'র নিবন্ধনের তথ্যের সূত্র ধরে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগকেই আইডেন্টিফাই করা হয়েছে। এখন তাদের কাছ থেকে প্রযোজ্য ট্যাক্স ও জরিমানা আদায় করার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।"
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট ট্যাক্স আদায় করবে। কিন্তু এসব গাড়ির মালিক যে অর্থ দিয়ে ওই গাড়ির মালিক হয়েছে, তা বৈধ না অবৈধ উপায়ে অর্জিত – তা দেখার দায়িত্ব এন্টি করাপশন কমিশনের (দুদকের)। যেহেতু গাড়ি ও মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেজন্য তাদের ওই গাড়ির টাকা কোথা থেকে এসেছে, কিংবা অবৈধ কিনা – তা বের করাও সম্ভব হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান টিবিএস-কে বলেন, "যেখানেই কর ফাঁকি পাওয়া যাবে, সেখানেই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।"

সাধারণত এসব উচ্চ মূল্যের গাড়ির উপর আমদানি শুল্ক ও কর অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে আমদানিকৃত বিলাসবহুল গাড়ির ট্যাক্স সিসি-ভেদে সর্বোচ্চ ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া এসব গাড়ি নিবন্ধনের সময় অগ্রিম কর পরিশোধও করতে হয়।
এদিকে আমদানি পর্যায়ে এসব গাড়ি থেকে সরকারের আমদানি কর পাওয়ার কথা। অন্যদিকে বিআরটিএ'তে গাড়ি নিবন্ধনের সময় অগ্রিম কর কর্তন করা হয়। তাহলে করফাঁকি কোথায় হয়েছে?
এনবিআরের কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা দেন, যে অর্থ দিয়ে ওই গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে, তা ট্যাক্স ফাইলে দেখানো হয়নি। বিদ্যমান আয়কর আইন অনুযায়ী, ব্যক্তির আয়ের ওপর কর ধার্য হয়। তাই ওই ব্যক্তি যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে গাড়ি ক্রয় করেছেন, এটিকে আয় হিসেবে গণ্য করে ওই অর্থের উপর ট্যাক্স হবে। কোনো ব্যক্তি তার গাড়ি ট্যাক্স ফাইলে না দেখানোর অর্থ হলো, তিনি সেটির ক্রয়মূল্য গোপন করেছেন, যার ওপর কর প্রযোজ্য হবে।
যেমন ধরা যাক, এক ব্যক্তি ৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি গাড়ি ক্রয় করেছেন, যা ট্যাক্স ফাইলে দেখানো হয়নি। তাহলে ওই পাঁচ কোটি টাকা ওই ব্যক্তির করযোগ্য আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং এর ওপর কর প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ আয়কর ছিল ৩০ শতাংশ। সেক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ করের আওতায় পড়বেন এবং ৫ কোটি টাকার ৩০ শতাংশ হিসেবে কর দিতে হবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রতি বছরের জন্য ১০ শতাংশ জরিমানা। অর্থাৎ যদি কেউ পাঁচ বছর ধরে একটি গাড়ি ট্যাক্স ফাইলে না দেখিয়ে থাকেন, তাহলে তার মূল ট্যাক্সের বাইরে জরিমানা হবে আরো কমপক্ষে ৫০ শতাংশ।
সিআইসি যেভাবে গাড়িগুলো খুঁজে পেল
গত প্রায় ছয় মাস ধরে বিআরটিএ'তে নিবন্ধন নেওয়া গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করার পর—ওই তথ্য সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স অফিসগুলোতে যাচাই করার জন্য পাঠায় সিআইসি। অফিসগুলো কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ডেটাবেজ এর সঙ্গে ক্রসচেক করার পর বেরিয়ে আসে কোন কোন টিআইএনধারী গাড়ির তথ্য তাদের রিটার্নে দেখাননি। আবার কেউ কেউ রিটার্নই জমা দেননি।
কিন্তু গত দুই বছর ধরে এনবিআরের ট্যাক্স এর সঙ্গে বিআরটিএ'র ডাটাবেজ এর ইন্টিগ্রেশন রয়েছে। ফলে এসব তথ্য রিয়েল টাইম পাওয়ার কথা। তা সত্ত্বেও না পাওয়ার কারণ কী?
এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেন, বিআরটিএতে গাড়ির নিবন্ধন নেওয়ার সময় কেবল টিআইএন নম্বর দিতে হয়। বিআরটিএ দেখবে ওই টিআইএন সঠিক কিনা। যার নামে গাড়ির নিবন্ধন হয়েছে, তিনি বছর শেষে যখন আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন, তখন ওই গাড়ি, গাড়ির ক্রয়মূল্যসহ যাবতীয় তথ্য দেখাবেন। কিন্তু বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তা করেনি।
মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি টিআইবির
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এসব গাড়ি কেনার অর্থ অবৈধ উৎস থেকে আসার সম্ভাবনা প্রবল।
তিনি বলেন, "এখানে সুস্পষ্টভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে। কর ফাইলে ঘোষণা না করায় ব্যবহৃত অর্থের বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে।"
তিনি আরও বলেন, "সিআইসি সঠিকভাবেই তথ্য উদঘাটন করেছে এবং বকেয়া কর আদায় করবে। কিন্তু এ অর্থ বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা তদন্তের দায়িত্ব দুদকের। যদি গড়মিল পাওয়া যায়, তবে দুদককে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।"