বাংলাদেশে দ্রুত সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আহ্বান অর্থনীতিবিদদের

দেশের অর্থনীতিবিদ ও নীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন সীমিত কিছু গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত অলিগার্কিক ক্ষমতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মৌলিক পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
আজ শুক্রবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্সে 'ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টস: আওয়ার কারেন্ট ইকোনমিক চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়েস ফরোয়ার্ড' শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এ আহ্বান জানান।
দুই দিনব্যাপী এই কনফারেন্সের আয়োজন করেছে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স (দায়রা)।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কেবল নীতিগত সংস্কারের ওপরই নির্ভর করছে না, বরং এটি ক্ষমতার আরও ন্যায্য বণ্টন, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ও উন্মুক্ত অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপরও নির্ভর করছে।
লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান ১৯৮০-২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে একটি বিস্তৃত পুঁজিবাদী শ্রেণির ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতা আবারও অল্প কিছু অলিগার্কিক শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। এতে প্রবৃদ্ধি কেবল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্য লাভজনক হয়েছে। আর এর ফলে অবকাঠামোগত ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ব্যাংক লুটপাট বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'এই অলিগার্কদের ক্ষমতা ভাঙতে হলে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, বড় বড় অপরাধ ও দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করা, লুট হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেরম্যান অ্যাক্টের মতো কঠিন প্রতিযোগিতা বিষয়ক আইন প্রয়োগ করা।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, টেকসই শিল্পায়নের জন্য মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে রয়েছে দুর্বল প্রতিষ্ঠান, অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার চক্র ও রাষ্ট্রীয় দখল।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালের পর থেকে কারচুপির নির্বাচন, রাজনৈতিক বৈধতার সংকট এবং অস্বচ্ছ চুক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব—এসবই বর্তমান চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
সেলিম রায়হান কর ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, বাণিজ্য নীতি এবং সরকারি ব্যয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের মতো বিষয়গুলো পুরোপুরি সংস্কারের আহ্বান জানান।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের চেয়ারপারসন নুরিয়া লোপেজ সতর্ক করে বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা, ব্যাপক অর্থায়ন ও লজিস্টিক খরচ বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
লোপেজ জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং সুপারিশ করেন, বাংলাদেশ যেন এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা বাড়িয়ে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী রোডম্যাপ প্রণয়ন করে।
অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ বলেন, অস্থিতিশীল সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর সংস্কার দাঁড় করানো বিপজ্জনক। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যতে ঝুঁকি এড়াতে নতুন একটি উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।