৯৫০ কোটি ডলারের কেলেঙ্কারি: ফিলিপিনোরা কেন ‘নেপো বেবিদের’ মুখোশ খুলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে?

ফিলিপাইনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে অস্বাভাবিক দুর্নীতির বিষয়টি জনসমক্ষে আসার পর সাধারণ ফিলিপিনোরা এ তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার ও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাত্রা ফাঁস করার জন্য রেডিটের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোকে বেছে নিচ্ছেন।
গত সপ্তাহজুড়ে সামাজিক মাধ্যমে এমন অনেক অ্যাকাউন্ট ও অনলাইন কমিউনিটি তৈরি হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিলাসবহুল জীবনযাপনের ভিডিও ও পোস্ট রিআপলোড ও সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে ব্যক্তিগত জেটে ভ্রমণ, বিদেশে দামি জিনিসপত্র কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার মতো বিষয়গুলোও রয়েছে।
এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট ক্রিয়েট করার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার ফলোয়ার পেয়েছে 'লাইফস্টাইলচেকপিএইচ' নামের একটি সাব-রেডিট। অনলাইন ব্যবহারকারীরা এখানে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের স্ক্রিনশট আপলোড করে সরকারি কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত 'দুর্নীতিবাজদের সুবিধাভোগী সন্তানদের', অর্থাৎ 'নেপো বেবি'দের মুখোশ উন্মোচন করছেন।
আগস্টের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র জানান, ২০২২ সাল থেকে বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য ৫৪৫ বিলিয়ন পেসো (৯৫০ কোটি মার্কিন ডলার) ব্যয় করা হয়েছে। এর আওতায় এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৮৫৫টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে।
টানা চার দিনের অবিরাম বৃষ্টির পর মেট্রো রাজধানী ম্যানিলা ও আশপাশের প্রদেশগুলো ভয়াবহ বন্যায় ডুবে গেলে এই প্রকল্পগুলো নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।
তদন্তে উঠে আসে, নিবন্ধিত ২ হাজার ৪০৯ ঠিকাদারের মধ্যে মাত্র ১৫ ঠিকাদার মোট বাজেটের ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ১০০ বিলিয়ন পেসোর বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। বাকি ৪৩৬ বিলিয়ন পেসো দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৯৪ ঠিকাদারকে।

তদন্তে আরও অনেক 'ভূতুড়ে প্রকল্পের' খোঁজ মিলেছে। এসব প্রকল্প এমন সব অবকাঠামোর যা কাগজে-কলমে সম্পূর্ণ দেখানো হলেও বাস্তবে কখনোই নির্মাণ করা হয়নি।
২০ আগস্ট মার্কোস একটি বিরান এলাকা পরিদর্শনের পর বলেন, তিনি অত্যন্ত 'ক্রুদ্ধ'। এই স্থানে ৫৫ মিলিয়ন পেসো ব্যয়ে একটি নদীর বাঁধ নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, 'তারা একদিনও কাজ করেনি।'
২৭ আগস্ট বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পগুলোতে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির অভিযোগের পর মার্কোস সব সরকারি কর্মকর্তার, বিশেষ করে সরকারি অবকাঠামো প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ডিপার্টমেন্ট অভ পাবলিক ওয়ার্কস অ্যান্ড হাইওয়েজ-এর (ডিপিডব্লিউএইচ) কর্মকর্তাদের জীবনযাত্রা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।
সৃজনশীল পরিচালক জেরি কাকানিন্দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, 'রেডিটে এখন এমন সব কমিউনিটি তৈরি হয়েছে যারা রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও ডিপিডব্লিউএইচ কর্মকর্তাদের সন্তানদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের ভিত্তিতে করে "লাইফস্টাইল চেক" করছে। এদের জীবনযাত্রা "ক্রেজি রিচ এশিয়ানস" সিনেমাকেও হার মানায়।' পোস্টটি ইতিমধ্যে ৭ হাজারেরর বেশি শেয়ার হয়েছে।
তিনি আরও লেখেন: 'একজন প্রশ্ন করেছেন: "বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দুর্নীতি করে গড়া এসব সম্পদ এমন নির্লজ্জভাবে দেখিয়ে বেড়ায়—এরা কীভাবে এত বোকা কেন?"'
'হতে পারে দুর্নীতি তাদের জগতে এতটাই স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে গেঁড়ে বসেছে যে তারা এখন এই সম্পদকে নিজেদের অধিকার বলে মনে করে। শুধু সম্পদই নয়, এমন সম্পদ যা সাধারণ ফিলিপিনো করদাতাদের কল্পনারও বাইরে, অথচ তাদের টাকাতেই এরা বিলাসী জীবনযাপন করছে।'

এর একটি বড় উদাহরণ হলেন ক্লডিন কো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিলাসবহুল জীবনযাত্রার বিভিন্ন চিত্র, এমনকি দামি জিনিসপত্রের মূল্যসহ পোস্ট করার জন্য পরিচিত তিনি। তার বাবা হাই-টোন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের মালিক। মার্কোসের নির্দেশে তদন্তের আওতায় আসা ১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এটি।
ক্লডিন কো কংগ্রেস সদস্য জাল্ডি কো-র ভাতিজিও। জাল্ডি কো সানওয়েস্ট ইনকর্পোরেটেড নামে আরেকটি নির্মাণ সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা। ওই প্রতিষ্ঠানের নামও আছে মার্কোস জুনিয়রের তদন্তের তালিকায়।
ক্লডিন কোর ইউটিউবে ৩ লাখ ও ইনস্টাগ্রামে ১ লাখের বেশি ফলোয়ার ছিল। তীব্র সমালোচনার মুখে সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন এই কনটেন্ট ক্রিয়েটর।
নিরাপদ সামাজিক পরিসর
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ব্যক্তিদের ঘিরে অনলাইনে তৈরি হওয়া এই আলোড়ন প্রমাণ করে, ফিলিপিনোদের জন্য রাজনৈতিক সমস্যাগুলোতে অংশগ্রহণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
ইউনিভার্সিটি অভ ফিলিপাইনস ডিলিম্যান-এর সমাজবিজ্ঞানী অ্যাথেনা শারান প্রেস্টো এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অনলাইনে ফিলিপিনোদের এই 'দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচনের' ঢেউ নতুন ঘটনা নয়। সরকারি দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য মানুষ বহু বছর ধরে নতুন নতুন মিডিয়াকে ব্যবহার করে আসছে।
এর একটি উদাহরণ দেখা গিয়েছিল ২০০১ সালে দেশটির দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থানের সময়। সে সময় এসএমএস মেসেজিংয়েএর মাধ্যমে 'টক-অ্যান্ড-টেক্সট' প্রযুক্তি ছিল অনেকটাই নতুন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেফ এস্ট্রাদার পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে ২০ লাখের বেশি মানুষ। বিক্ষোভকালীন এক সপ্তাহে ৭ কোটিরও বেশি টেক্সট মেসেজ চালাচালি হয়েছিল।
প্রেস্টো বলেন, 'আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী জাতি। ফিলিপিনোদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্র থেকে সোশ্যাল মিডিয়াকে আলাদা করা কঠিন, বিশেষ করে আমাদের যখন ইতিহাসে নতুন ধারার গণমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্র'শাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।'
প্রেস্টো আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফিলিপিনোদের সৃজনশীল উপায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে মিম তৈরি থেকে শুরু করে অনলাইন তর্ক-বিতর্ক পর্যন্ত রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক স্যামুয়েল কাবুয়াগ। তিনি বলেন, 'সোশ্যাল মিডিয়া এখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও তথ্য ফাঁসের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। একে সেলেব্রিটি কালচারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে যেকোনো কেলেঙ্কারি—তা যতই সাধারণ বা গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন—সহজেই প্রচার ও প্রসার পায়।'
কাবুয়াগ আরও বলেন, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এসব কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়ার সহজ সুযোগ করে দিয়েছে। সেগুলোর ওপর মতামত প্রকাশেরও সুযোগ করে দিয়েছে। 'এতে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক খবর বা উদ্বেগ নিয়ে কথা বলা সহজ হয়ে যায়।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর সুবাদে মাsনুষ দৈনন্দিন সমস্যা ও বাস্তবতাও উপলব্ধি করতে পারছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই গবেষক বলেন, 'অতীতে আমরা কেবল সংবাদপত্র বা রেডিওর খবরের উপর নির্ভর করতাম, যেখানে তথ্য সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত আকারে আসত। কিন্তু রেডিটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে আরও বেশি কনটেক্সট ও তথ্য সরবরাহ করে বিষয়গুলো বুঝতে সাহায্য করে, যা হয়তো অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে আগে উল্লেখ করা হয়নি।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেডিটের মতো ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহারকারীদের পরিচয় গোপন রাখার যে সুবিধা দেয়, সে কারণেও তারা এসব বিষয়ে আলোচনা করতে এবং অনলাইনে সাহসী দাবি পোস্ট করতে নিরাপদ বোধ করেন।
প্রেস্টো বলেন, 'আপনি একা নন—এই অনুভূতি জাগানোর জন্য রেডিট খুবই কার্যকর। তবে এখানকার ফাঁদ হলো, তথ্য ফাঁসের পোস্টটি সেখানেই থেমে যায়…কিন্তু যদি সেই একই রাজনীতিবিদরা ফের নির্বাচিত হন, তাহলে এক ধরনের মোহভঙ্গ ও উদাসীন তৈরি হতে পারে।'