পোশাক খাতে সাব-কন্ট্রাক্টররাও পাবেন রপ্তানি প্রণোদনার অংশ

তৈরি পোশাক (আরএমজি) উৎপাদনে সাব-কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরি ব্যবহারকারী রপ্তানিকারকদেরও বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতদিন এ সুবিধা কেবলমাত্র নিজস্ব কারখানায় উৎপাদনকারী রপ্তানিকারকদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এ সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোও ০.৩ শতাংশ হারে প্রণোদনার একটি অংশ পাবে। এতে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড—তৈরি পোশাক শিল্প আরও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী চীন ও ভারতের তুলনায় কম শুল্ক সুবিধা থাকায়—বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অর্ডার গ্রহণের সক্ষমতা আরও বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজস্ব পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক ২০ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে শুল্কের হার ৫০ শতাংশ এবং চীনের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ। শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সুবিধাজনক হার মার্কিন বাজারের জন্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে।
এই সুযোগ কাজে লাগাতেই অর্থ মন্ত্রণালয় সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগে রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের এজন্য আবেদন করেছিল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হলেও প্রস্তাবনার সার-সংক্ষেপ এখনো অর্থ উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
এদিকে সাব-কন্ট্রাক্টররা সরাসরি সরকারের কাছ থেকে এ প্রণোদনা না পেলেও রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে এর সুফল ভোগ করবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
এফবিসিসিআই এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "সাব-কন্ট্রাক্ট করা কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনার অংশ দিতে হবে-এমন দরকষাকষি করে আন্তর্জাতিক বায়ারদের কাছ থেকে রপ্তানিকারকরা বাড়তি মূল্য আদায় করতে পারবে।"
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ১০ শতাংশ সাব-কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। নতুন উদ্যোগের ফলে এর অংশ আরও বাড়বে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "যেহেতু সাব-কন্ট্রাক্ট কোম্পানিগুলো সরাসরি এক্সপোর্ট করে না, তাই তাদের বিল অব এন্ট্রি না হওয়ার কারণে তাদেরকে সরাসরি ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) দেওয়া যায় না। সাব-কন্ট্রাক্ট কোম্পানিকে প্রণোদনার দেওয়ার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে খুবই ভালো।"
তিনি আরও বলেন, "তবে সাব-কন্ট্রাক্ট কোম্পানিগুলো যাতে সরাসরি প্রণোদনা পেতে পারে, সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কোন মডিউল প্রস্তুত করে দেওয়ার কথা বললে, আমরা তা করে দেওয়ার চেষ্টা করব।"
সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা
শিল্প সংশ্লিষ্টরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এতে ছোট কারখানাগুলো টিকে থাকতে পারবে এবং দেশের পোশাক রপ্তানির বাড়াতে অবদান রাখতে পারবে।
বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, কেবল যেসব রপ্তানিকারকের নিজস্ব কারখানা আছে, তারাই নগদ প্রণোদনা পাচ্ছেন। অন্য কারখানায় বা সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে উৎপাদন হলে তা প্রণোদনার আওতায় আসত না।
এ কারণে প্রত্যক্ষ রপ্তানিকারকরা সাব-কন্ট্রাক্টে যেতে নিরুৎসাহিত হতেন, ফলে অনেক ছোট ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ সাব-কন্ট্রাক্টের উৎপাদনকে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন হিসেবে দেখিয়ে সুবিধা নিয়েছেন।
এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, "যদিও প্রণোদনা প্রথমে রপ্তানিকারকের কাছেই যাবে, কিন্তু সাবকন্ট্রাক্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। রপ্তানিকারকরা এ প্রণোদনার একটি অংশ শ্রমিকদের মজুরি বা অন্যান্য সুবিধা দিতে ব্যবহার করতে পারেন।এতে ছোট ছোট কারখানাগুলো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হবে এবং সেখানে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।"
বিজেএমইএ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান বাবু টিবিএসকে বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে বিজিএমইএ থেকে মন্ত্রণালয় এবিষয়ে মতামত নিয়ে থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
বিকেএমইএ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় যে সাব-কন্ট্রাক্টিং কোম্পানিগুলোর জন্য প্রণোদনা চালু করছে, এ সম্পর্কে মন্ত্রণালয় বিকেএমইএ'র মতামত নিয়েছে।
তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে ব্যাক টু ব্যাক এলসি যিনি খুলবেন, তিনিই প্রণোদনা পাবেন। তবে সাব-কন্ট্রাক্টর কোম্পানিগুলো সরাসরি প্রণোদনার অর্থ না পেলেও এর সুবিধার ভাগীদার তারাও হবেন।"
হাতেম আরও জানান, অনেক বায়িং হাউজ বিদেশ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে সাব-কন্ট্রাক্ট এর মাধ্যমে উৎপাদনের পর রপ্তানি করে। এছাড়া, কিছু ট্রেডার আছেন, যাদের নিজস্ব কোন কারখানা নেই, তারা স্টক লট মালসহ ছোট-খাট গার্মেন্টসে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করেন, তবে তারা এ প্রণোদনা সুবিধা পাবেন না।
এদিকে সরকার স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) আগে ধীরে ধীরে সামগ্রিক প্রণোদনার হার কমানোর পরিকল্পনা করছে। এ অবস্থায় বিজিএমইএ চলতি অর্থবছরের জন্য প্রণোদনার হার বাড়ানোর অনুরোধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত মোট ৫,৬৯৬ কোটি টাকা প্রণোদনা পেয়েছিল।
প্রণোদনা বাড়ানোর দাবি বিজিএমইএর
গত ১১ আগস্ট বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান বাবু স্বাক্ষরিত আবেদনে বিদ্যমান বিশেষ নগদ সহায়তার হার ০.৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা, শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র ব্যাক এর পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তার হার বিদ্যমান ১.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা হার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার দাবি করেছে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ বলেছে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আমাদের সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত এক বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে সংকট, শ্রম অসন্তোষ ও সার্বিক নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু পোশাকের মূল্য বাড়েনি বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমেছে। ফলে বস্ত্র ও পোশাকখাতে বিনিয়োগ কমে আসছে।
সংগঠনটি বলেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বস্ত্রখাতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৪.৩৮ শতাংশ। এছাড়া, ভারত সরকারের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার পাশাপাশি সকল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পোশাক রপ্তানিতে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা আমাদের দুঃচিন্তার বিষয়।
বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪–৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, ১৯৭৮ সালে মাত্র ১০ হাজার ডলারের রপ্তানি দিয়ে খাতটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই–এপ্রিল সময়ে পোশাক রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৪০.২০ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯.৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।