মে মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি আবারও ৮ শতাংশের নিচে

ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আস্থা কিছুটা ফিরে আসা এবং এক মাসে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাহের পরও ২০২৪ সালের মে মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি ফের কমে ৮ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এ বছর এটি ছিল সর্বনিম্ন মাসিক প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮.৩২ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৭৩ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের মে মাস শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুন শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.২৫ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ হার কমতে থাকে। গত বছরের আগস্টে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ৭.০২ শতাংশে, যা ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সামান্য ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও এপ্রিল থেকে আবারও নিম্নমুখী ধারায় ফিরে আসে। এর ধারাবাহিকতায় মে মাসে গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত মূল্যস্ফীতি কমলে আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ে। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে মানুষের আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়লে আমানত কমবে, এটাই স্বাভাবিক।
চলতি বছরের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৯.১৭ শতাংশ থেকে ৯.০৫ শতাংশে। জুনে এটি আরও কমে দাঁড়ায় ৮.৪৮ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২৭ মাস পর প্রথমবারের মতো মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নেমেছে।
এদিকে, মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ৯.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো তা দেশের মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে বেশি। ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও আমানত বাড়ছে না।"
তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে। এছাড়া, জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদ হওয়ায় অনেকেই তখন আমানত ভেঙেছেন, যার প্রভাবও পড়েছে মে মাসের চিত্রে।
একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকের অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ ফেরতের অনিশ্চয়তায় গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তত ১৩টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, নামসর্বস্ব ঋণ বন্ধে পদক্ষেপ, এবং লিকুইডিটি সাপোর্ট দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খুব একটা উন্নত না হলেও আর অবনতি হয়নি। অনেক ব্যাংক এখন আমানতের জন্য ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। তবে মানুষের হাতে জমানোর মতো বাড়তি টাকা না থাকায় গ্রোথ বাড়ছে না।
এক মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছে ১৬,৪০০ কোটি টাকা
গত এপ্রিল মাসে কিছুটা কমে এলেও মে মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ফের বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল শেষে মানুষের হাতে নগদ ছিল ২.৭৭ লাখ কোটি টাকা। মে মাস শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২.৯৪ লাখ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৬,৪০০ কোটি টাকা।
আগের বছরের মে মাসের তুলনায় এই বৃদ্ধি ৮.৫৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের মে মাসে মানুষের হাতে নগদ ছিল ২.৭১ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের বাইরে নগদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এতে ব্যাংকে টাকা জমা কমে যায়, ফলে মানি ক্রিয়েশন বাধাগ্রস্ত হয়। আর ব্যাংকে নগদ ফেরত এলে তারল্য বাড়ে, যা বিনিয়োগ ও ঋণ সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "মে মাসে ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটার জন্য এবং কোরবানির পশু কেনার লেনদেন নগদে হওয়ায় মানুষের হাতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে যায়।"
একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, মূল্যস্ফীতির হার কমলেও এখনো তা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে খরচ মেটাতে মানুষ নগদ টাকার ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদের পরিমাণ ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা। ইনফ্লেশনারি চাপে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে এবং ২০২৪ সালের মার্চ শেষে সর্বোচ্চ ২.৯৬ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়।