মূল্যস্ফীতিজনিত চাপে এপ্রিলে আমানতে প্রবৃদ্ধি কমে ৮.২১ শতাংশ

ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করলেও গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির চাপে আমানতে প্রবৃদ্ধি মার্চের তুলনায় ৩০ বেসিস পয়েন্ট কমেছে।
মার্চ মাসে আমানতে প্রবৃদ্ধি ৮.৫১ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা গত বছরের আগস্টের পর থেকে সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এপ্রিল মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮.২০ লাখ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৮.২১ শতাংশ বেশি।
২০২৫ সালের এপ্রিল শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ছিল ১৬.৮১ লাখ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ আগের তুলনায় কমলেও সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে এখনও অনেক বেশি। ফলে এই চাপ মানুষজনকে খরচ বেশি করতে বাধ্য করছে। এই কারণে তারা সঞ্চয় বাড়াতে পারছে না।'
অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে যাওয়াও আমানতে প্রবৃদ্ধি কমার একটি বড় কারণ মন্তব্য করে এই ব্যাংকার বলেন, 'বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেক কমে গেছে। ফলে বাজারে টাকার মুভমেন্টও কমে গেছে। আর টাকার মুভমেন্ট কমলে আমানত কীভাবে বাড়বে?'
টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানো, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অনেক কারণে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। এপ্রিল ও মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনও ৯ শতাংশের ওপরেই আছে।
এর ফলে মানুষকে আয়ের একটি বড় অংশ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে খরচ করতে হচ্ছে। আবার এমনও অনেক পরিবার আছে যারা আগে থেকে জমানো আমানত তুলে খরচ মেটাচ্ছে বলে জানান তারা।
তারা আরও বলেন, এপ্রিলে ব্যাংকিং খাতে নিট আমানত বেড়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা, দুই বছর আগেও মাসিক প্রবৃদ্ধি নিয়মিত ২০ হাজার কোটি ছাড়াত।
বিচ্ছিন্নভাবে দুই-এক মাস আমানতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা ওপরের দিকে গেলেও সামগ্রিকভাবে ধারা বদলাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তারা।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯.২৫ শতাংশ। তবে তার পর থেকে আমানতে প্রবৃদ্ধি কমার ধারায় চলে আসে। গত বছরের আগস্টে আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.০২ শতাংশ।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অল্প হলেও আমানতে প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। মার্চে রেকর্ড রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯.৫১ শতাংশ আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে এপ্রিলে সেটি আবার কমেছে।
গত এক বছর ধরে আমানতে প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০২৪ সালের শুরুর দিকেও এটি ১০.৫ শতাংশের বেশি ছিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার বেশ কিছু ঘটনা নজরে আসার পর গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা তাদের আমানতের টাকা ঠিকমতো ফেরত না পাওয়ায় খাতটি নিয়ে আতঙ্ক বেড়ে যায়।
অগাস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতে সবগুলো দুর্বল ব্যাংকের অবস্থা খুব বেশি ভালোর দিকে না গেলেও খারাপের দিকে যাওয়া ঠেকানো গেছে।
তবে এসব ব্যাংকের অধিকাংশই ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার দিয়েও আমানত টানতে পারছে না। উল্টোদিকে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক আমানতে প্রবৃদ্ধি কম দেখালেও ভালো ব্যাংকগুলো আমানতে ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি করছে।
ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ১৯ হাজার ৬৫ কোটি
কয়েকমাস ধরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমার ধারায় থাকলেও মার্চে ঈদ উপলক্ষে সেটি বেড়ে গিয়েছিল। এপ্রিলে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ আবার আগের ধারায় ফিরেছে।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, মার্চ শেষে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ছিল ২.৯৬ লাখ কোটি টাকা। এপ্রিলে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২.৭৭ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১৯ হাজার ৬৫ কোটি টাকা কমেছে।
অবশ্য গত বছরের একই মাসের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ৪.৯২ শতাংশ বেশি। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়। কারণ ব্যাংকের বাইরে থাকলে টাকার হাতবদল হওয়া কমে যায়, যেটি দিনশেষে মানি ক্রিয়েশন কমিয়ে দেয়।
মানুষের হাতে থাকা টাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংকে ফিরলে একদিকে যেমন ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতিত ভালো হয়, অন্যদিকে ঋণযোগ্য তহবিলের পরিমাণ বাড়ায় দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতিজনিত চাপের কারণে এরপর থেকে প্রতি মাসেই এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। পরে গত বছরের জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২.৯২ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছায়।