তৃতীয় দফায় বাণিজ্য আলোচনার আগে অর্থনীতিবিদ, মার্কিন প্রতিষ্ঠানের মতামত নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনা শুরুর আগে দেশের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন মন্ত্রণায়ের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি— বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসারত মার্কিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এর অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার বিকেলে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি– শেভরন ও এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। মার্কিন কোম্পানি দু'টির প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন বলে জানা গেছে।
একইদিনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসন্ন আলোচনার জন্য— বাংলাদেশের আলোচনাকালীন অবস্থান চূড়ান্ত করতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করে। ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র, খাদ্য, কৃষি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরও কয়েকটি পরামর্শমূলক সভা নির্ধারিত রয়েছে—এর মধ্যে ১৮ জুলাই ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের (ইউএসএসইসি) সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক, এবং ২২ জুলাই আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে আরেকটি বৈঠকের কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিনের অন্যতম বড় আমদানিকারক দেশ, অন্যদিকে 'এএএফএ' হচ্ছে এমন একটি মার্কিন সংগঠন যা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও জুতা আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক কমাতে—যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করছে, সেসব কোম্পানির মতামত নেওয়ার পাশাপাশি তাদের সহযোগিতা চাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে সম্পৃক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর মতামত ও সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে, যাতে আসন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করা যায়।"
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, তৃতীয় রাউন্ড আলোচনা কবে নাগাদ শুরু হবে, সে সম্পর্কে এখনও বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে কিছু জানে না। তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া চুক্তির খসড়ার ওপর বাংলাদেশ মতামত দেওয়ার পর—নেগোসিয়েশনের সময়সূচি ইউএসটিআর থেকে ঢাকাকে জানানো হবে। তবে আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, আগামী ২১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের বিমান টিকেট বুকিং দিয়ে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।"
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয় রাউন্ড আলোচনা শেষে ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় বাণিজ্য উপদেষ্টা দেশে ফেরার পর থেকেই—তৃতীয় রাউন্ড আলোচনার প্রস্তুতি বেশ জোরেশোরে নেওয়া হচ্ছে। ১৪ জুলাই দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতামত নেওয়ার পর, বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় যেসব আলোচনা হয়
গতকালকের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান টিবিএস'কে বলেন, আমদানি-রপ্তানির অনেক কিছু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এবং এবিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের নিজস্ব আইন ও বিধিমালা আছে।
তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যেসব বিষয় সম্পৃক্ত রয়েছে, সেসব বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই ওই সব মন্ত্রণালয়ের মতামত ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। মার্কিন ট্যারিফের (শুল্ক) বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে এখন রেগুলার মিটিং হবে।"
বাণিজ্যসচিব আরও বলেন, ''তারপর আমরা বাংলাদেশের অবস্থান চূড়ান্ত করে একটি খসড়া যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাব। তার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে মধ্যে তৃতীয় রাউন্ড নেগোসিয়েশন হবে।"
বাংলাদেশ কবে নাগাদ প্রস্তাব পাঠাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমরা এবিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জানতে চেয়েছি, তারা এখনো আমাদের কিছু জানায়নি।"
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে তাদের মন্ত্রণালয়ের কোন আপত্তি আছে কি-না, বা সংশ্লিষ্টখাতের দেশীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কি-না, সে বিষয়ে মতামত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় কেন পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের উপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপসহ বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে হারে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছিল, তাতে বাংলাদেশ খুব বেশি চিন্তিত ছিল না। কারণ, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের উপর ৪৬ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছিল। এতে ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ ছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় দফার আলোচনার শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন যে ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হবে, যেখানে বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কই বহাল থাকবে— যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দোনেশিয়ার ওপরও প্রথমে ৩২ শতাংশ শুল্কারোপ করার পর গতকাল তা কমিয়ে ১৯ শতাংশ নির্ধারণ করার ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এছাড়া, প্রতিযোগী ভারতের উপর আরোপিত শুল্ক হারও ২৬ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশের নিচে নামতে পারে ভারতে অবস্থানরত ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের থেকে ধারণা পেয়েছে দেশটি।
দ্বিতীয় দফা আলোচনার সময় বাংলাদেশের ধারণা ছিল যে, শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশই সবচেয়ে এগিয়ে আছে, এবং ৯ জুলাইয়ের আগে ভিয়েতনামসহ কোনো দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবে না।
এছাড়া, ব্লুমবার্গের একটি সংবাদ পড়ে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করা এক বছরের জন্য স্থগিত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, এবং শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনা করবে না ইন্দোনেশিয়া।