কঠোর অবস্থানে সরকার, আতঙ্কে এনবিআর কর্মকর্তারা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং বন্দর কার্যক্রমে 'কমপ্লিট শাতডাউন' দেওয়ার পর কঠোর অবস্থানে গেছে সরকার, যার শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনারসহ পাঁচজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে।
অফিশিয়াল সূত্রে জানা গেছে, আরও অন্তত ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আলোচনা চলছে। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত থেকে শুরু করে বদলি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত দুই দিনে ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এনবিআরের শীর্ষস্থানীয় দুইজন কর্মকর্তা বাদে বাকিরা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। ফলে কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বর্তমান সরকারও দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বাধ্যতামূলক অবসরে এনবিআরের চার কর্মকর্তা
সরকার গতকাল এনবিআরের চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক দুটি আদেশ জারি করা হয়।
আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শুল্ক কার্যক্রম ব্যাহত করার অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করার ঠিক একদিন পরই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
অবসরে পাঠানো কর্মকর্তারা হলেন: এনবিআরের সদস্য (চলতি দায়িত্ব) (মূসক নীতি) ড. মো. আবদুর রউফ, সদস্য (গ্রেড-২) (সদস্য শুল্ক নীতি ও আইসিটি) হোসেন আহমদ, সদস্য (কর) (গ্রেড-২) আলমগীর হোসেন ও বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) শাব্বির আহমেদ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চার কর্মকর্তারই চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাদের চাকরি থেকে অবসর দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছে। সেজন্য সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হয়েছে। তারা বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী অবসরকালীন সুবিধাদি পাবেন।
বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রধান কার্যালয় ও মাঠ পর্যায়ের অফিস—উভয় ক্ষেত্রেই ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও অস্বস্তি টের পাওয়া গেছে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এগিয়ে আসা শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারাও চলমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা শিগগিরই সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে সংযম প্রদর্শনের এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানাবেন।
সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্র্যাকডাউন হবে না বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছে, আরও কিছু কর্মকর্তার ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আসতে পারে।
গতকালের বাধ্যতামূলক অবসরের আদেশের আগে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আরো কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।' তবে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে তিনি রাজি হননি। শুধু বলেন, 'সময় হলে দেখতে পাবেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এই আন্দোলনের পেছনে অনেক বড় শক্তি কাজ করেছে—দেশের এবং বিদেশের।'
তবে এনবিআর আন্দোলনের নেতারা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তাদের একজন বলেন, 'আমাদেরকে দেশবাসীর কাছে ক্রিমিনাল বানানো হচ্ছে। অথচ কমপ্লিট শাটডাউনে আমরা তো একদিনে যাইনি। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা আমাদের কথা শুনতে চাননি।'
তিনি আরও বলেন, 'সবগুলো অফিসে চাপা ক্ষোভ, আতঙ্ক, অস্থিরতা। এভাবে স্বাভাবিক কাজ চলে না।'
তীব্র প্রতিক্রিয়ার ভয়ে কোনো কর্মকর্তাই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
এনবিআরের আওতাধীন অফিসগুলোতে মোট জনশক্তির সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার। এর মধ্যে কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০।
সরকারের এমন কঠোর অবস্থানে এনবিআর সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত না করার আহ্বান জানিয়ে তারা শিগগিরই সরকারকে চিঠি পাঠাতে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, 'পরিস্থিতি যাতে আর উত্তপ্ত না হয়, সেজন্য শান্ত থাকতে এনবিআর চেয়ারম্যান এবং অর্থ উপদেষ্টাকে আমরা চিঠি পাঠাব, এর ড্রাফট রেডি হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'অসৎ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তবে তার আগে সংস্কার হতে হবে।'
অবশ্য অপর একজন ব্যবসায়ী নেতা, যিনি অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত ছিলেন, টিবিএসকে বলেন, 'এ ধরনের বড় কনফ্লিক্টের পর (কমপ্লিট শাটডাউন) কিছু ড্যামেজ তো হবেই। তবে অর্থ উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, বড় ধরমের ক্র্যাকডাউন হবে না।'
উল্লেখ্য, সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি পৃথক বিভাগ তৈরি করার পরই কর্মকর্তারা আন্দোলনে নামেন। তাদের অভিযোগ ছিল, এনবিআর সংস্কার সুপারিশ পাশ কাটিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই অধ্যাদেশগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।