২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট: স্বচ্ছতা বাড়াতে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ আরোপের পরিকল্পনা

কর ন্যায্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার সারচার্জের বিধান সংশোধনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে বর্ধিত করের বদলে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হবে।
এই পদক্ষেপের লক্ষ্য কর রিটার্নে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকৃত সম্পদ প্রদর্শনে করদাতাদের উৎসাহিত করা।
বর্তমানে ৪ কোটি টাকার ওপর যেকোনো সম্পদ থাকলে তার ওপর বিভিন্ন স্তরে প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ (করের ওপর কর) দিতে হয়। এই পদক্ষেপ মূলত উচ্চ-আয়ের করদাতাদের লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তি খাতের আমদানিকারকদের এখন আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। বছর শেষে যদি কেটে নেওয়া এআইটির পরিমাণ করদাতার প্রকৃত প্রদেয় করের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এআইটি বা বেশি করের ওপর সারচার্জ আদায় করা হয়।
ফলে একদিকে করদাতাকে প্রকৃত করের চেয়ে বেশি কর দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে ওই বর্ধিত করের ওপরই সারচার্জ হিসাব করায় বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে।
ধরা যাক, আমদানি পর্যায়ে একজন আমদানিকারকের কাছ থেকে এআইটি হিসেবে ১০০ টাকা কেটে নেওয়া হলো এবং বছর শেষে তার প্রকৃত কর হলো ৫০ টাকা। ওই ব্যক্তির যদি ৪ কোটি টাকার ওপর সম্পদ থাকে (যেকোনো রূপে), তাহলে তিনি প্রদেয় করের ওপর সারচার্জ দেবেন—সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমান ব্যবস্থায় ১০০ টাকার ওপর হিসাব করায় এই করহার ১০০ টাকার ৩৫ শতাংশ বা ৩৫ টাকা হয়ে যায়।
কিন্তু যদি প্রকৃত কর হিসাব করা হতো, তাহলে ওই আমদানিকারক সারচার্জ দিতেন ৫০ টাকা করের ওপর। যেমন, ৩৫ শতাংশ সারচার্জ হলে প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ প্রদেয় হতো ১৭.৫ টাকা—অর্থাৎ কার্যত করের বোঝা অর্ধেক কমে যাবে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এনবিআর সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে।
এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের অভিযোগ ছিল। কারণ এই ব্যবস্থা কার্যত তাদের করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।
অনেকেই বলেছেন, এ ব্যসবথার কারণে তারা প্রকৃত সম্পদের হিসাব দেখাতে নিরুৎসাহিত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বর্তমানে অগ্রিম করসহ মোট কেটে নেওয়া কর প্রকৃত করের চেয়ে বেশি হলেও ওই টাকার ওপরই সারচার্জ দিতে হয়।
'কর ন্যয্যতার বিবেচনায় এবং করদাতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই শুধু প্রকৃত করের ওপরই সারচার্জ আরোপ করা হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে করদাতাদের সম্পদ লুকানোর প্রবণতা কমবে এবং প্রকৃত আয় ও সম্পদ দেখাতে উৎসাহিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
২ জুন অর্থ অধ্যাদেশ জারির সময় অর্থ উপদেষ্টা এ বিষয়টির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারেন।
করদাতা ও বিশেষজ্ঞরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে একইসঙ্গে তারা অগ্রিম কর্তিত কর বছর শেষে প্রকৃত করের সঙ্গে সমন্বয় করার বা রিফান্ড দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করাও যৌক্তিক বলে মত দেন।
স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির কর বিশেষজ্ঞ এবং ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা প্রায়ই উৎস থেকে কেটে নেওয়া বা সংগৃহীত করকে ন্যূনতম কর হিসাবে বিবেচনা করে, যার ফলে ইফেক্টিভ করহার স্ট্যাচুটরি হারের চেয়ে বেশি হয়। আগে থেকেই বর্ধিত এই করের বোঝার ওপর সারচার্জ আরোপ আরও বৈষম্য তৈরি করে।
'সারচার্জ বিধান সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রকৃত স্বস্তির জন্য অতিরিক্ত অগ্রিম অর্থ প্রদান রোধ করতে উৎস থেকে কর কর্তন ও সংগ্রহের হার ব্যাপকভাবে যৌক্তিকীকরণ প্রয়োজন।'
এইচএনএস গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং বারভিডার সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন: 'একজন আমদানিকারকের কাছ থেকে প্রথমে বাড়তি কর আদায় করা হয়। পরবর্তীতে প্রকৃত কর কম হলেও তা রিফান্ড করা হয় না। উল্টো ওই বর্ধিত করের ওপর আবার সারচার্জ আদায় করা হয়। পৃথিবীর কোথাও এমন বাজে ব্যবস্থা সম্ভবত নেই।'
'এ কারণে মানুষ প্রকৃত সম্পদ গোপন করতে চান' উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ আরোপের বিধান যুক্ত করা হলে তাতে মানুষ সম্পদ দেখাতে উৎসাহিত হবেন।
বর্তমানে চার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদধারী ব্যক্তিদের কোনো সারচার্জ দিতে হয় না। নিট সম্পদ ১০ কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকার কম হলে বা দুটি গাড়ি থাকলে অথবা নিজ নামে ৮ হাজার বর্গফুটের গৃহসম্পত্তি থাকলে প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।
সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সারচার্জের হারও বারে। ১০ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার নিচে সম্পদধারীর ২০ শতাংশ, ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটির নিচে সম্পদধারীর ৩০ শতাংশ এবং ৫০ কোটির বেশি সম্পদধারীর ৩৫ শতাংশ সারসার্জ দিতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি অগ্রিম ও অন্যান্য করসহ ১ কোটি টাকা কর পরিশোধ করেন এবং তার ৫০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ থাকে, তবে তাকে সারচার্জ হিসাবে অতিরিক্ত ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
দেশে বর্তমানে কতজন মানুষ সারচার্জ ব্যবস্থার আওতায় পড়েন, সে বিষয়ে কোনো সরকারি তথ্য পাওয়া যায় না।
তবে গ্লোবাল ওয়েলথ ডেটাবুক ২০২১ অনুযায়ী, ১ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা) মূল্যের সম্পদধারী বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়ে ২৮ হাজার ৯৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এই সব ব্যক্তিকেই যে বাড়তি করের ওপর সারচার্জ দিতে হয়, তা নয়।